অর্থনীতিজাতীয়বাংলাদেশসর্বশেষ নিউজ

ছুটিতে দেশে এসে বিপাকে ঝিনাইদহের প্রবাসিরা, চোখে মুখে শুধুই হতাশার ছাপ

তারেক জাহিদ, ঝিনাইদহঃ ছুটিতে বাড়ি আসা প্রায় শতাধিক রেমিট্যান্স যোদ্ধা ফ্লাইট বন্ধ থাকায় আর কর্মস্থলে যেতে পারছেন না। এদিকে তাদের মধ্যে পাসপোর্ট ভিসার মেয়াদও অনেকের শেষ হয়ে গেছে। কর্মস্থলের কোম্পানীর নিকট পাওনা বেতনের টাকা না পেলেও বাড়িতে বসে কেউ কেউ মোবাইল ম্যাসেজে চাকরী হারানোর চিঠি পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এমন অবস্থা বিরাজ করছে প্রবাসী অধ্যুষিত ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের দামোদরপুর গ্রামে। ছুটিতে আসা প্রবাসীরা তাদের পাওনা বুঝে পেতে রি এন্ট্রি ভিসার (৩ মাসের ভিসা) ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারী হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার সর্বশেষ প্রান্তের দামোদরপুর গ্রামটিতে গেলে দেখা যায় গ্রামের মধ্যে গড়ে উঠেছে রঙ বেরঙের বসতবাড়ি। বাড়ি গুলো রঙ ও নকশায় শহরের বাড়ি গুলোকে হার মানিয়েছে গ্রামের সকল দিক দিয়েই যেন তাদের একেবারে শিখরে অবস্থান। তবে ছুটিতে এসে বাড়িতে থাকা প্রবাসীরা শোনালেন হতাশার গল্প।

কালীগঞ্জ উপজেলা পরিসংখ্যান ও নির্বাচন অফিস সূত্রে জানাগেছে, আজ থেকে ৯ বছর আগে গত ২০১১ সালের শুমারী অনুযায়ী দামোদরপুর গ্রামের মোট জনসংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৯’শ৯৬ জন। এরমধ্যে পুরুষ ১ হাজার ৯,শ আটত্রিশ জন আর মহিলা দুই হাজার আটান্ন জন। একই বছরের ভোটার তালিকা অনুযায়ী এ গ্রামের মোট ভোটার সংখ্যা দুই হাজার নয়শ, ৪ হাজার ৩,শ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার এক হাজার চারশ একাশি জন। আর মহিলা ভোটার সংখ্যা এক হাজার চারশ বাষট্্ির জন।

ইউপি সদস্য জাফর ইকবাল জানান,এক সময়ে তাদের গ্রামের বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যদের দিন কেটেছে অনাহারে অর্ধাহারে থেকে। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ পরিবার গুলো বসবাস করতেন মাটির অথবা বেড়ায় তৈরী ঝুপড়ি ঘরে। কিন্তু প্রবাসীদের টাকায় আজ প্রতিটি পরিবারে আকর্ষনীয় দালান ঘর নির্মিত হয়েছে। অন্যদিকে তাদের পাঠানো রেমিটেন্স দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে একদিনের জ্বরাজীর্ণ গ্রামটি। কিন্তু এখন ওই গ্রামের প্রবাসীরা আশা -নিরাশার দোলায় দুলছেন। যারা প্রবাসে আছেন শত প্রয়োজনেও তারা কর্মহারানোর ভয়ে ছুটিতে বাড়ি আসতে পারছেননা। আবার যারা ছুটিতে আছেন তারা ফ্লাইট বন্ধ থাকায় আর যেতে পারছেন না। ফলে তারা পড়েছেন চরম অনিশ্চয়তায় গ্রামবাসিরা জানান,আয়তন ও লোকসংখ্যার দিক দিয়ে তাদের গ্রামটির অবস্থান এ উপজেলার মধ্যে বড়। প্রবাসীদের সংখ্যার দিক দিয়ে ও গ্রামটির অবস্থান এ উপজেলার মধ্যে শীর্ষে এবং সারাদেশের মধ্যে অন্যতম। অথচ এক সময়ে এ গ্রামের এ মানুষ ছিল শুধুমাত্র কৃষি নির্ভর দিন মজুর শ্রেনীর। বেকারত্বের কারণে অভাব তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াতো। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। কেননা গ্রামটির কর্মক্ষম মানুষের একটা বিরাট অংশ প্রবাসে গিয়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর কারণে তাদের পরিবার গুলোর মাঝে ব্যাপক স্বচ্ছলতা ও সক্ষমতা এসেছে। গ্রামের লোকসংখ্যা অনেক বেশি হলেও অনেক মানুষ বিদেশে থাকার কারণে তারা ভোটারও হতে পারেননি। আবার বিদেশ থেকে ফিরে অনেকে আশপাশের গ্রাম ও শহরে গিয়ে সব আলিশান বাড়িনির্মানের মাধ্যমে বসবাস করছেন। গ্রামবাসীদের দাবি গ্রামের সব মানুষ গ্রামটিতে ফিরলে মোট লোকসংখ্যা হবে প্রায় ৬ হাজারের অধিক।

আলহাজ আক্কাচ আলী জানান, গ্রামটি থেকে এবং এ উপজেলা থেকে তিনিই প্রথম ১৯৮০ সালে শ্রম বিক্রি করতে লিবিয়াতে গিয়েছিলেন । সেখানে ২ বছর থাকার পর বেতন কম হওয়ায় ফিরে এসে ৬ মাস পরে ১৯৮২ সালের মাঝামাঝিতে সৌদি আরব যান। এ থেকেই শুরু। পরে গ্রামের মসলেম উদ্দীন, ইসমাইল হোসেনসহ আরও বেশ কয়েকজনকে তিনি নিয়ে যান। তারা এসে আবার স্বজনসহ গ্রাম বাসীদের বিদেশে কাজের জন্য নেওয়া শুরু করেন। এভাবে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে প্রবাসীদের সংখ্যা। গ্রামের অনেকেই কর্মক্ষম যুবকদের প্রবাসে পাঠাতে কাজ করেছেন। তবে এ কাজে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন গ্রামের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম। ওই গ্রাম থেকে সবচেয়ে বেশি দিন প্রবাসে জীবন কাটানো সুলতান আহম্মেদ জানান, তিনি ১৯৮৬ সালে মালয়েশিয়াতে গিয়েছিলেন। এরপর কয়েক বার কিছু দিনের জন্য ছুটিতে এসে আবার চলে গেছেন। সর্বশেষ মাত্র ৮ মাস আগে একাধারে প্রায় ৩৪ বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে একবারে চলে এসেছেন। তিনি আরও বলেন, প্রবাসে থেকে অর্থ পাঠিয়ে নিজের ভাই ভাইপোসহ গ্রামের অনেককে নিয়ে গেছেন।

সুলতান আহম্মেদের ভাষ্য, তাদের যৌথ পরিবারে মোট কর্মক্ষম পুরুষের সংখ্যা ছিল ১১ জন। তাদের মধ্যে এক সময়ে মোট ১০ জন ছিল প্রবাসে। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রথম দিকে আপনজনদের ছেড়ে থাকতে খুব খারাপ লাগতো। বিশেষ বিশেষ দিন গুলোতে বাড়ির সকলের কথা খুব মনে পড়তো। যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু এখনকার দিনে তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির কারণে যে কোন সময়ে পরিবারের সদস্যসহ দেশের সকলের সাথে যোগাযোগ করা সহজ হয়েছে। ফলে প্রবাস জীবনের আগের দিনের মত কষ্ট এখন আর অনুভূত হয় না। কিন্তু নিরাশার গল্প শোনালেন ওই গ্রামের খোরশেদ আলম,সাগে ৪ বছর আগে তিনি কাতারে গিয়েছিলেন। প্রায় ৯ মাস আগে ছুটিতে বাড়িতে এসে আর যেতে পারেননি। কর্মস্থানের কোম্পানীতে তিনি বাংলাদেশী প্রায় ৮ লাখ টাকা পাবেন। এখন মালিকপক্ষ মোবাইল ফোনও রিসিভ করছেন না। পরিশ্রমের মাধ্যমে ওই দেশের কোম্পানীতে জমানো টাকা পাওয়া নিয়ে পড়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়।

মালয়েশিয়া প্রবাসী শামছুল আলম জানান, ১১ বছর মালয়েশিয়ায় ছিলেন। ছুটিতে বাড়ি এসে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় এখন আর যেতে পারছেন না। কোম্পানীতে বাংলাদেশী সমমানের প্রায় ১২ লাখ টাকা পাবেন। এদিকে ভিসা পাসপোর্টের মেয়াদ ও শেষ হয়ে গেছে। তার মত এমন জটিলতায় পড়েছেন ছুটিতে আসা দেশের অনেক প্রবাসীই। এখন সরকারী হস্তক্ষেপ ছাড়া তাদের এ পাওনা টাকা উদ্ধারের কোন পথ নেই।

সাইদুর রহমান জানান, তিনি দুবাইতে ছিলেন। ছুটিতে বাড়ি এসে আর যেতে পারেননি। আশা ছিল তার করনা পরিস্থিতি একটু সাভাবিক হলে যেতে পারবেন। কিন্তু কোম্পানীর পক্ষ থেকে কয়েকদিন আগে মোবাইল ম্যাসেঞ্জারে ক্যানসেল লেটার পাঠানো হয়েছে। ফলে সব আশা শেষ হয়ে গেছে। তিনি হতাশা জড়িত কণ্ঠে বলেন, কোম্পানীতে আড়াই লাখ টাকা পাবেন। ব্যাংক একাউন্টও ওই দেশে। সরকারী হস্তক্ষেপ ছাড়াা ওই টাকাও পাবেন না।এই গ্রামের অনেকেই পড়েছেন এমন ঝামেলায়। তাদের দাবি, অনেক দেশে লকডাউন তুলে নেওয়া হয়েছে। আবার অনেক দেশে নতুন করে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি যাই হোক সরকারী ভাবে উদ্যোগ নিয়ে তাদের জন্য রি এন্ট্রি ভিসার (৩ মাসের জন্য) ব্যবস্থা করলে তারা কর্মস্থলের দেশে গিয়ে পাওনাদি বুঝে পেতে পারেন।

কোলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ডাঃ নুরুল ইসলাম জানান, তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন দেখেছেন কৃষি নির্ভর এ গ্রামটির অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অনেক দূর্বল। সে সময়ে বাড়ি বাড়িতে অভাব লেগে থাকতো। কিন্তু বর্তমানে তাদের গ্রামের প্রায় ১ হাজার মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত রযেছেন। এখন গ্রামের সব মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে। তিনি আরও জানান, তাদের গ্রামের মোট যে ভূখন্ড সে তুলনায় লোকসংখ্যা অনেক বেশি। তবে দীর্ঘ সময় প্রবাসে থেকে অর্থ রোজগার করে ফিরে এসে অনেক মানুষ পার্শ্ববর্তী শহর ও গ্রামে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। তা না হলে গ্রামের ভোটার ও লোকসংখ্যা আরও বেশি হত। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে যারা ২০ বছর আগে গ্রামটি দেখেছেন তারা এখন গ্রামের মধ্যে ঢুকে বড় বড় বাড়ি দেখে চিনতে পারেন না। এমন উন্নতির মধ্যেও করোনা প্রচন্ড ছাপ পড়েছে। ছুটিতে যারা এসেছিলেন করোনা পরিস্থিতিতে ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা আর যেতে পারছেন না। এখন তারা পড়েছেন চরম হতাশায়। ওই গ্রামের আরেক সমাজ সেবক হারুন অর রশিদ মোল্ল্যা জানান, তাদের গ্রামটি এ উপজেলার মধ্যে অন্যতম বড় গ্রাম। প্রায় বারো’শ কর্মক্ষম মানুষ রয়েছে প্রবাসে। একসময় এলাকার মানুষ তাদের গ্রামকে দিনমজুর অধ্যূষিত গ্রামহিসেবে চিনতেন। সেই গ্রামেই ২০ বছরের ব্যবধানে গড়ে উঠেছে আলিশান বাড়ি। জরিপ করে দেখা গেছে গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকেই দুই একজন করে মানুষ প্রবাসে আছেন। কোন কোন বাড়িতে প্রবাসিদের সংখ্যা আরও বেশি। প্রবাসে থাকলেও গ্রামের সব মানুষই পরষ্পরে বন্ধু ভাবাপন্ন। তাই গ্রামের উন্নয়নে এবং সামাজিক কোন প্রতিষ্ঠান তৈরী অথবা কোন অনুষ্ঠান করতে গেলে সাধ্যমত বিদেশ থেকেই খরচের টাকা পাঠিয়ে দিতে কার্পন্য করেন না। ফলে অন্য গ্রামের চেয়ে তাদের গ্রাম খানিকটা ভিন্ন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে এখন বিরাট ধাক্কা লেগেছে গ্রামটিতে।

কোলা ইউনয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন মোল্লা জানান, তার ইউনিয়নের মধ্যে দামোদরপুর সবচেয়ে বড় গ্রাম। এক গ্রাম নিয়েই একটি ওর্য়ার্ড। এক সময়ে এ গ্রামের মানুষ খুব দরিদ্র ছিল। কিন্তু গ্রামটি থেকে অনেক মানুষ বিদেশে রয়েছেন। অনেকে দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে ব্যবসা বানিজ্য করছেন। আবার তাদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ও ভূমিকা রাখছে। যে কারণে সারাদেশের মধ্যে এ গ্রামটি বেশ ব্যতিক্রমী বলে তিনি মনে করেন। ছুটিতে আসা সেই গ্রামের প্রবাসীদের আর যেতে পারছেন না। আবার কর্মস্থলে তাদের পাওনাও রয়েছে। বিয়ষটি নিয়ে সরকারী হস্তক্ষেপ প্রযোজন।

ঝিনাইদহ জেলা কর্মসংস্থান ও শ্রম অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সবিতা রানী মজুমদার জানান, কোন গ্রামের মানুষ শ্রম শক্তি রপ্তানীতে এগিয়ে এমন হিসাব এই মুহুর্তে তিনি বলতে পারছেন না। তবে জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর গ্রামের অনেক কর্মক্ষম মানুষ প্রবাসে থাকায় উন্নত গ্রামে পরিণত হয়েছে এটা তিনি জানেন। ছুটিতে বাড়িএসে যারা আর প্রবাসে যেতে পারছেন না তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, বিশ্বব্যাপি করনার সময়ে অবশ্যই ধৈয্য ধারন করতে হবে। কোভিড ১৯ এর কালো থাবায় অনেক দেশে এখনও শ্রমিক নেয়া বন্ধ। তবে ওমান থেকে ফেরত আসা প্রবাসীরা যেতে পারছেন। করোনা পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক পর্যায়ে আসলে অবশ্যই যেতে পারবেন। মহামারীর বিশেষ পরিস্থিতির কারণে প্রবাসিদের পাওনাদীসহ সকল বিষয় নিয়ে তারা ডাটা এনিট্রর কাজ শুরু করেছেন। ক্ষতি গ্রস্থরা প্রয়োজনে ঋণ নিয়ে এদেশেও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কিছু করতে পারবেন। কাজেই হতাশ হওয়ায় কিছু নেই।

Related Articles

Close