বাংলাদেশ
যে দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী কালো নারীকে মা মেনে পূজো দেন সে দেশেই নারীদের সাদা কালো ভেদাভেদ করা হয়।
যূথিকা জাকারিয়াঃ আমার গায়ের রঙ নিয়া বাড়ির মানুষ বড় চিন্তায় ছিল! বিশেষত আমার ডাকসাইটে সুন্দরী মা। তাঁর কাছে আমার গায়ের রঙ গ্রহনযোগ্য ছিলনা,নিজেরই অযোগ্যতা বলে মনে করতেন। তাঁর কোন পূর্বপুরুষের রক্তের কারণে আমার এমন দশা হলো তা ভেবে অস্হির হতেন। আমার বাপের দিকের আত্মীয়দের রঙ দেখাই যেতো ঝকঝকে, তাই সব রকমের অঘটনের দায় নিজের দিকেই টানতেন।
দুধে জাফরান বা কেসর মিশিয়ে খাওয়ানো হতো। দিদুন খুব খুব যত্ন নিতেন, যেন ত্বক মাখন পেলব হয়৷ স্নান করাতেন নিজের হাতে।
একটু বড় হবার পরে বেসন, কাঁচা হলুদ বাটা মেখে স্নান। তিলের তেলে দূর্বাঘাসের রস মিশিয়ে মাখতে হতো।মা যখন সানন্দার সব রূপচর্চা স্পেশাল সংখ্যা আলাদা করে করে পড়তে দিতেন তখন লজ্জায় নুয়ে পড়তাম। রাতের খাবার টেবিলে সবার সামনে যখন বলতেন আজ শশার রস মেখেছো? কষ্ট হতো খুব! আমি আমার মায়ের মেয়ে হিসেবে সুখী ছিলাম কিন্তু আমার মা নন।
আমার মায়ের খুব বেড়াবার সখ ছিল। একসময় আমাকে সঙ্গে নেয়া বন্ধ করলেন৷
দিন যাচ্ছিল দিনের নিয়মে, বড় হচ্ছিলাম। যথারীতি নানান রকমের রুপ টান চলছিল।এরপরে ঘরোয়া মিটিঙে স্বীদ্ধান্ত হলো ফেয়ারনেস ক্রিম দরকার আমার, বেসন টেসনে কাজ হবেনা। একদিন এক বান্ধবীর সঙ্গে বাইরে বেরোবো বলে তৈরী হচ্ছিলাম। বেরোবার মুখে সে হঠাৎ বলে বসলো, তুই যে মুখে কিছু দিলি না? ফেয়ার এন্ড লাভলি দে নাহলে আরো কালো লাগবে! আমি জানলাম ফর্সারাও ফর্সা হতে চায়, তারাও রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের গ্রাহক।
আমি আমার জীবনে এতো এতো কালো মেয়ের তুমুল প্রেমের সাক্ষী যে কালো বলে প্রেম হবেনা এমন কখনো ভাবি নাই। যদিও টিভিতে তখন ঐন্দ্রিলা এড করতো, রঙ কালো বলে প্রেম হচ্ছিল না। ফেয়ারনেস ক্রিমের ম্যাজিকে প্রেম হলো। কিন্তু বাস্তবে তখনও
কালো মেয়ের সফল প্রেম, সফল বিয়ে বহু দেখেছি। আর কালো মেয়ের সফল কেরিয়ার তো ভুরি ভুরি উদাহরণ। কালো মেয়ের ত্বকের জেল্লা এমন যে মনে পড়ায় কালো কেউটের টানটান চামড়াকে। সাঁওতাল, মুন্ডা, কোচ মেয়ের কালো চোখের অতল আহ্বান উপেক্ষা করার সাহস রাখে কজন!!হোক তার গায়ের রঙ তেল চকচকে কালো।
তারপরেও কথা থাকে,যেদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী জাতিগতভাবে মিশ্রণের ফল, অধিকাংশ মানুষ বাদামী বর্ণের তারা করে গায়ের রং নিয়ে আলাপ!! যে মা নিজে শ্যামলা বা কালোই তিনি নিজেও ছেলের বউ আনতে খোঁজেন ফর্সা মেয়ে। বেমালুম ভুলে যান তার নিজের মেয়েটাও শ্যামলাই।
আবার মজা দেখুন এই দেশের এক বড় জনগোষ্ঠীর লোকেরা মা ডেকে মা মেনে পূজা দেন এক কালো নারীকেই। এই দিগম্বরী নারী কতটা শক্তি ধরেন তা বোঝা যায় না কি তাঁর রূপে! কালো চুলের, এক কালো নারী যে এই অঞ্চলের ঘরের মেয়ের মতো আবার মায়েরও মতো বটে। কিন্তু
যাঁরা এই দেবীকে মানেন তাঁরাও সাদা কালোর ভেদ করেন৷ গঙ্গা অববাহিকার এই বদ্বীপে আর্য অনার্যের লড়াই আজো রয়ে গেছে গায়ের রঙ নিয়ে আলোচনায়। কালিকা তাই অনার্যের দেবী, আদ্যাশক্তি। কিন্তু তাঁকেও আজ মেকওভার করতে হয়, সাজতে হয় ট্রেন্ডি সাজে।
যদিও শিবের মতো কালীরও নানান রূপ তবুও ভদ্রকালী বেশেও মুন্ডমালার বদলে জড়োয়ার গহনা আর দিগম্বরীর বদলে স্কার্ট পরিহিতা দেবীকে চিনতে বড় কষ্ট হয়। ভাবতে অবাক লাগে এদেশে সৌন্দর্যের মাপকাঠি ঝকঝকে ফর্সা ত্বক, যদিও এই দেশটা বাদামী বর্ণের জনগোষ্ঠীরই।
শুভ দীপাবলি
ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত