জাতীয়বাংলাদেশবিনোদনসাহিত্য

আমার নায়করাজ : নির্মলেন্দু গুণ

নির্মলেন্দু গুণ

নায়করাজ রাজ্জাক বেশ সুস্থই ছিলেন। কিছুদিন আগে একটি টেলিভিশন প্রোগ্রামে তাকে দেখলাম, তিনি সেখানে কবরীর সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে রসিকতা করছেন। তাকে দেখে বেশ সুস্থই মনে হল। কিন্তু হঠাৎ করে এমন একটি ঘটনা ঘটে যাবে, এটি ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। তার মৃত্যুর ঘটনাটি খুবই আকস্মিক, কারণ তিনি মাঝে বেশ অসুস্থ হয়ে আবার মোটামুটি সুস্থও হয়ে উঠেছিলেন।

মাঝে এফডিসির সাথে তার বোধহয় কোনো দ্বন্দ্ব হয়েছিল। তি20799301_503206240024284_6967097882106859405_nনি এফডিসি ত্যাগ করেছেন, এফডিসিতে আর কখনো আসবেন না, এরকমের একটি অভিমানের বিষয় সম্পর্কে শুনেছিলাম। আমি জানি না ভেতরের ঘটনাটি কী, কিন্তু এটা আমার কাছে মনে হয়েছে রাজ্জাক সাহেবের মতো লোক, যাকে ইন্ডাস্ট্রির ফাউন্ডার বলা যেতে পারে, সুতরাং একজন ফাদার ফিগার হয়ে সেইখানে তিনি কেনো বলেছিলেন এফডিসিতে আর যাবেন না; এরকম অভিমানী একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কোনো জানি না।

ব্যক্তিগত জীবনে আমার সাথে তার খুব যে দেখা এবং প্রচুর সাক্ষাৎ হয়েছে তেমনটি নয়। কখনো কখনো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে- এই যেমন গতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে তার সাথে দেখা হয়েছিল। সেটিই সম্ভবত সামনাসামনি শেষ দেখা ছিল তার সাথে। এরপর আর তার সাথে সরাসরি দেখা হয়নি।

পাকিস্তান পিরিয়ডে একসময় এফডিসি এবং সিনেমার অভিনয় শিল্পীদের সাথে, পরিচালকদের সাথে- জহির রায়হান, রোজী সামাদ- যিনি পরবর্তীকালে রোজী আফসারী হয়েছিলেন, সামাদ সাহেব- বড় ক্যামেরাম্যান ছিলেন- সত্য সাহা, সুবল দাস, এদের সাথে আমার ভালো সম্পর্কও ছিল। তো পাকিস্তান আমলে এই ব্যক্তিদের কারণে চলচ্চিত্রের সাথে আমার একটি সরাসরি সম্পর্ক ছিল। সে সময়ে চলচ্চিত্রের জন্য আমি গানও লিখেছিলাম। ফেরদৌসী রহমান সেই গান গেয়েওছিলেন। সামাদ সাহেবের একটি ছবি আছে ‘সূর্যগ্রহণ’, ঐ সময়টাতে চলচ্চিত্রের সাথে আমার একটি সম্পর্ক ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, জহির রায়হানকে একসময় যখন আমরা হারালাম তখন চলচ্চিত্রের সাথে আমার ঘনিষ্ট সম্পর্কের ইতি হয়। বলা যায় জহির রায়হানের কারণেই এই ইতি সুচিত হয়। যে কারণে পরবর্তীকালে নায়করাজ রাজ্জাকের সাথে সিনেমার সূত্রে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হওয়ার সুযোগ হয়নি।

আমার বন্ধু মামুনুর রশীদ- সে সময় থেকেই বড় বড় নাট্যকার এবং অভিনেতাদের সাথে সম্পর্ক ছিল, আমরা মগবাজারে তাজ হোটেলে আড্ডা দিতাম। আমার বন্ধু নায়ক সোহেল রানা- আমরা কিন্তু সহপাঠি- আমরা একরুমে থাকতাম আনন্দমোহন কলেজে। ফলে সোহেল রানা তারপরে দুলু- মানে নায়ক ফারুক- এরা চলচ্চিত্রে আসার আগে থেকেই তাদের সাথে আমি পরিচিত। এদের কারণে রাজ্জাক সাহেবের সাথে আমার পরিচয় সম্ভব হয়েছিল বেশ আগে থেকে। বাংলা চলচ্চিত্রের সাথে সরাসরি সম্পর্কও এদের মাধ্যমে।

কিন্তু সে সময়ের নায়িকাদের সাথে আমার তেমন পরিচয় হওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে জহির রায়হানের মাধ্যমে ববিতার সাথে পরিচয় হয়েছিল তার প্রথম সিনেমায়। ‘লেট দেয়ার বি লাইট’-এ তিনি প্রথমে অলিভিয়াকে নায়িকা হিসেবে কাস্ট করেছিলেন। পরে তিনি যখন সুমিতা দেবীকে ত্যাগ করে সুচন্দাকে বিয়ে করেন তখন ওই পরিবারের সাথে তার একটি ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। তখন অলিভিয়াকে বাদ দিয়ে ববিতাকে এই সিনেমায় তিনি কাস্ট করেছিলেন। এবং সেই ব্যাপারটি কেমন হয়েছে তিনি জাজ করার জন্য একবার আমাকে তার সেটে দাওয়াত দিয়েছিলেন। সেখানে আমি গিয়েছিলাম। এবং ববিতাকে দেখেছিলাম- স্কার্ট পরা একটি মেয়ে দোতালা থেকে নেমে আসছে। আমি যখন এই দৃশ্যটি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম- তখন তিনি আমার পিঠ চাপড়ে হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, নায়িকা পছন্দ হয়েছে কি না। আমি তখন বেশ লজ্জা পেয়েছিলাম।

এরপর ববিতা তো খুব অল্পদিনের মধ্যেই ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করলেন। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় অভিনয় করে নিজের দক্ষতার পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি একটি মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন। তিনি শুধু আমাদের বাংলাদেশে নয় পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরও মন জয় করেছিলেন। এই ববিতা এবং রাজ্জাক সাহেব জুটি বেঁধে আমাদের বহু সুপারহিট সিনেমাও উপহার দিয়েছিলেন।

পর্দায় রাজ্জাক সাহেবকে সর্বপ্রথম আমি অভিনেতা হিসেবে মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম সম্ভবত ১৯৬৮ সালে ‘আবির্ভাব’ সিনেমার মাধ্যমে। প্রধান চরিত্রে অভিনয় না করলেও এটি সম্ভবত কবরীর সাথে তার প্রথম সিনেমা। পরবর্তীকালে কবরীর সাথেও তার জুটি বিশাল জনপ্রিয়তা লাভ করে।

তবে আমি পরবর্তীকালে সিনেমা দেখাটা কন্টিনিউ করিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে হলে গিয়ে সিনেমা দেখাটা একপ্রকার বাদই দিয়ে দিয়েছিলাম বলা যায়। এর আগে ষাটের দশকে সিনেমা হলে যেতাম।

তবে একথা সত্য স্বাধীনতার পর বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে প্রধানতম হলেন রাজ্জাক সাহেব। তিনি নিজেকে অনুকরণ এবং অনুসরণযোগ্য একটি ব্যক্তিত্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধু বাংলাদেশেই নয় পশ্চিমবঙ্গেও তিনি সমান জনপ্রিয় ছিলেন। আমার কাছে মনে হয়, যৌথ প্রযোজনার যেসব সিনেমা ভারতের সাথে করেছিলেন তার মাধ্যমে কলকাতায় যে জনপ্রিয়তায় অর্জন করেছিলেন সেটি কিছু অংশে রঞ্জিত মল্লিকের জনপ্রিয়তার সমকক্ষ ছিল। আমি কলকাতার অংশে জনপ্রিয়তার কথা বলছি।

রাজ্জাক সাহেব ছিলেন একজন সহজ সরল মানুষ। বিভিন্ন সময়ে তার সাথে আলাপ-আড্ডার মাধ্যমে সে পরিচয় আমি পেয়েছি। একটি মজার ঘটনা আছে যার মাধ্যমে তার সারল্যের পরিচয় মিলবে। আমার কবিবন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে চলচ্চিত্র ঘনিষ্ঠ ছিল সাযযাদ কাদির। তিনি জীবনের প্রথম দিকে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন। তার সাথে আমিও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে যেতাম। তখন দৈনিক পাকিস্তানের ওখান থেকে ‘বিচিত্রা’ নামে একটি কাগজ বের হয়। ফজল শাহাবুদ্দীন ছিলেন এটির সম্পাদক। এখন এনাদের তিনজনের কেউই বেঁচে নেই, আমি ছাড়া।

তো যাই হোক, শাহাবুদ্দীন আমাকে এবং সাযযাদ কাদিরকে একসাথে পাঠালেন রাজ্জাক সাহেবের বাসায়। লক্ষ্য- রাজ্জাক সাহেবের একটি সাক্ষাৎকার আনা। মূলত সাক্ষাৎকারটি সাযযাদই নিবে, আর আমার কাজ সঙ্গ দেওয়া, দুই একটি প্রশ্নও করা। তো ওইসময় রোজার মাস ছিল। সময় যাচ্ছিল কথা হচ্ছিল, আমাদের কিছু খেতে দেওয়ার দিকে রাজ্জাক সাহেবের খেয়াল ছিল না। তিনি আলাপে মগ্ন ছিলেন। তখন তার সাথে আমার সখ্য তো দূরে থাক পরিচয়ও তেমন ছিল না। কারণ কবি হিসেবেও তিনি আমাকে চিনতেন না।

আসলে পাকিস্তান আমলে আমার কবি পরিচয়টি কবি মহলের মধ্যে থাকলেও বাইরে ছড়িয়ে পড়েনি। তো তিনি আমাকে চিনতেন না। আমার দাড়িও ছিল সে সময়। কথার ফাঁকে সন্ধ্যা আসন্ন, আমি ভাবলাম রাজ্জাক সাহেবকে একটু বিব্রত করি- আমি তাকে বললাম- ‘একটু পানি দিন রোজা ভাঙবো’। উনি শুনেই লজ্জা পেয়ে গেলেন, বললেন রোজা রেখেছেন বলবেন তো, এরপর উনি আমাদের অনেক খাবার পরিবেশন করলেন। জানালেন বিষয়টি জিজ্ঞেস করার ব্যাপারে উনি ভুলেও গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ফজল শাহাবুদ্দীনের কাছে উনি টেলিফোন করে এই ভুলে যাওয়ার জন্য সরি বলে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। এবং তিনি যে লজ্জিত সেটিও বলেছিলেন। তো এই ঘটনা থেকেই তার সারল্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।

তবে পরবর্তীকালে, মানে স্বাধীনতার পরে তিনি যখন আমাকে চিনেছিলেন, তখন বুঝতে পেরেছিলেন সেই ঘটনা নিছকই মজা করার জন্যই ছিল। কিন্তু এর জন্য তিনি কিছু বলেননি, বরং তার সাথে আমার সম্পর্ক আরও উন্নত হয়েছিল।

Related Articles

Close