বাংলাদেশসর্বশেষ নিউজ

টাঙ্গাইলে নিজ পরিবারের সদস্যদের হাতেই ছয় মাসে ১২ খুন

খুনচলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে টাঙ্গাইলে নিজ পরিবারের সদস্যদের হাতে আটটি ঘটনায় ১২ জন খুন হয়েছেন। এ ঘটনাগুলোর মধ্যে মায়ের হাতে ছেলে, ছেলের হাতে মা, ভাইয়ের হাতে ভাই, ছেলের হাতে বাবা, ভাসুর হাতে ভাইয়ের স্ত্রী এবং ভাইয়ের স্ত্রীর হাতে ভাসুর এর খুনের ঘটনা রয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) সদর উপজেলার রসুলপুর এলাকায় স্বামী-স্ত্রী খুনের ঘটনা ঘটেছে।

এদিকে গত শুক্রবার (২৮ জুলাই) দুপুরে নিহত অনিল-কল্পনা দম্পতির ছেলে নির্মল চন্দ্র দাস বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে টাঙ্গাইল সদর থানায় মামলা করেছেন। পুলিশ গত শুক্রবার (২৮ জুলাই) রাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অনিল কুমারের বৈমাত্রেয় ভাই রতন চন্দ্র দাস ও স্বপন সৌমিত্রকে আটক করেছে। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল বলে সদর থানার ওসি জানিয়েছেন।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের রসুলপুরে সেফটিক ট্যাংক থেকে গত বৃস্পতিবার (২৭ জুলাই) রসুলপুর বাছিরন নেছা উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অনিল কুমার দাস (৬৮) ও তাঁর স্ত্রী কল্পনা দাসের (৬০) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মাদক, যৌন সহিংসতা, জমি নিয়ে বিরোধ থেকে এসব হত্যাকান্ড ঘটেছে। প্রায় সবগুলো হত্যাকান্ডের পর অভিযুক্তরা পালিয়ে না গিয়ে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে স্থানীয় জনগন বা পুলিশের কাছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক বৈষম্য, অস্থিরতা এবং ভেঙে পড়া পারিবারিক মূল্যবোধ মানুষকে এমন হন্তারক বানাচ্ছে। দারিদ্র নির্মূল করে বৈষম্য কমানো এবং পারিবারিক বন্ধন জোরদার করার তাগিদ দিয়েছেন এসব বিশেষজ্ঞরা। নিজ পরিবারের সদস্যদের হাতে খুনের সবচেয়ে নির্মম ঘটনাটি ঘটে গত (২৯ মার্চ) টাঙ্গাইল সদর উপজেলার দাইন্যা ইউনিয়নের বিন্যাফৈর গ্রামে। ওই গ্রামের হালেমা বেগমকে (৪৮) তার ছেলে হযরত আলী (২৪) নেশার টাকার জন্য অত্যাচার করতেন। ঘটনার দিন দিবাগত রাতে নেশার টাকার জন্য হযরত মায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করে। টাকা না দেয়ায় মায়ের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। এতে রাগে, ক্ষোভে মা ছেলের মাথায় সাবল দিয়ে আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই ছেলের মৃত্যু হয়। পরদিন সকালে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে এবং হালেমা বেগমকে গ্রেপ্তার করেন।

সবর্শেষ গত (২৯ এপ্রিল) নাগরপুরে সহবতপুর ইউনিয়নের চরভাঙ্গা গ্রামে নেশার টাকা না দেয়ায় ছেলে আজাহার আলী (২৫) তার বাবা লাল মিয়াকে (৫৫) কুপিয়ে হত্যা করে। আগের দিন লাল মিয়া তার নিজের চিকিৎসার জন্য একটি গরু বিক্রি করেন। আজাহার গরু বিক্রির টাকা তার বাবার কাছে চায়। টাকা দিকে অস্বীকৃতি জানালে বাবাকে কুপিয়ে পালিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই লাল মিয়ার মৃত্যু হয়। পরদিন পাশের গ্রাম থেকে আজাহার আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জেলার মধুপুরের আউষনারা ইউনিয়নের কৈয়াপাড়া গ্রামে নেশার টাকা না দেয়ায় মিরাজ (২৮) নামক এক যুবক গত (১৩ মার্চ) তার মা মিনারা বেগমকে (৪৮) কুপিয়ে হত্যা করে। মিনারা বেগমকে রক্ষা করতে আকবর আলী (৬০) নামক এক প্রতিবেশী এগিয়ে এলে তাকেও মিরাজ কুপিয়ে হত্যা করে। পরে আশেপাশের লোকজন তাকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে। মাদক সংক্রান্ত এসব ঘটনার পাশাপাশি জমির বিরোধেও খুনোখুনি হয়েছে এ সময়ে।

গত (২৫ এপ্রিল) বাসাইলের ফুলকি ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামের জমি সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে মৃত সোমেজ উদ্দিনের ছেলে হানিফ (৫০) ও দুলাল (৪৫) এর মধ্যে বিরোধ হয়। হানিফ তার লোকজন নিয়ে ছোট ভাই দুলালের উপর হামলা করে। আহত অবস্থায় দুলালকে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন। নিহত দুলালের স্ত্রী এ ঘটনায় হানিফসহ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে মামলা করেছেন। গত (২৭ এপ্রিল) বাসাইল উপজেলার নাকাসিম গ্রামে নিলু সরকারকে (৬০) জমি সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে তার ভাতিজা দীপক সরকার এবং ভাতিজির স্বামী সুবল সরকার মারপিট করে। আহত অবস্থায় নিলু সরকারকে বাসাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন।

গত (২৪ এপ্রিল) সখীপুরের হতেয়া কাজীপাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলীর (৫৫) মরদেহ মির্জাপুর উপজেলার হলুদিয়াচালা এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। আগের দিন তার ভাতিজা রফিকুল ও নাতি পনির আত্মীয়বাড়ি যাওয়ার কথা বলে সেখানে নিয়ে মোহাম্মদ আলীকে হত্যা করে ডোবার মধ্যে লাশ ফেলে রাখে। পরে পুলিশ রফিকুল ও পনিরকে আটকের পর তারা হত্যা করে লাশ ফেলে রাখার কথা স্বীকার করে। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ি পুলিশ হলুদিয়াচালা থেকে মোহাম্মদ আলীর লাশ উদ্ধার করে। যৌন নিপীড়ণের কারণে নিজ পরিবারের মধ্যে খুনের ঘটনা আছে। নাগরপুরের গাংবিহালী গ্রামে এক গৃহবধুকে তার ভাসুর মিজানুর রহমান (৩৮) গত (১৭ এপ্রিল) ঘরে ঢুকে ধর্ষনের চেষ্টা করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই গৃহবধু মিজানুর রহমানের মাথায় শাবল দিয়ে আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই মিজানুরের মৃত্যু হয়।

নাগরপুর উপজেলার ভাড়রা ইউনিয়নের খাসশাহাজানি গ্রামে গত (৭ ডিসেম্বর) হযরত আলী (৫০) ও তার ভাই সোলায়মান (৩৫) মধ্যে বিরোধ হয়। সোলায়মানের স্ত্রী সাজু বেগম (২৫) এই বিরোধ থামাতে গেলে হযরত আলী লাঠি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সোলায়মান তার ভাই হযরত আলীকে লাঠি দিয়ে পেটায়। এতে ঘটনাস্থলেই সাজু বেগম এবং হযরত আলীর মৃত্যু হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি, নগরায়ন, নতুন প্রযুক্তি সমাজে হঠাৎ করেই কিছু পরিবর্তন এনেছে। আর এর সঙ্গে মানুষ খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। ফলে দেখা দিচ্ছে অস্বস্তি।’ তিনি আরও বলেন, জমি সংক্রান্ত বিরোধ এবং মাদকের মতো বিষয়গুলো সরাসরি অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমদ বলেন, পরিবার বড় পরিবর্তন ঘটছে এ দেশে। পারিবারিক এসব হত্যাকান্ড বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্যমূলক না। হতাশা থেকে আগ্রাসী হয়ে ওঠার পরে অনুতপ্ত হচ্ছে অপরাধীরা। আর এটা শুধু টাঙ্গাইলে বাড়ছে তাই না। তিনি আরও বলেন, এখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ব্যক্তি সর্বস্বতায় পরিণত হয়েছে। সামাজিক বৈষম্য চরমভাবে বেড়ে গেছে। আর এর ফলে ক্ষুব্ধ, হতাশ মানুষটি নিজের পরিবারের ওপরই চড়াও হচ্ছে। তাহলে এসব থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার উপায়গুলো কী? দুই বিশেষজ্ঞরই কথা, এর সাদামাটা বা চটজলদি কোনো সমাধান নেই।

হেলাল উদ্দিন আহমদ মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হলো মানুষে মানুষে বৈষম্য কমাতে হবে। দারিদ্র দূর করতে হবে। আর পারিবারিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হবে। সন্তানকে গুণগত সময় দিলে মাদক বা পারিববারিক অন্যান্য সহিংসতা রোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন এ গবেষক। অধ্যাপক জিয়া রহমান মনে করেন, অর্থনীতি পুঁজিবাদী ভাবধারার হলেও নব্য পুঁজিবাদী এ ধারা এখনো মানবিক হয়ে উঠতে পারেনি। এখন দরকার সামাজিক নানা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, আর তাতেই নতুন সৃষ্টি হওয়া সামাজিক অস্থিরতা প্রশমন করতে পারবে এমন প্রতিষ্ঠান।

Tags

Related Articles

Close