বাংলাদেশসর্বশেষ নিউজ
টাঙ্গাইলের ডিসি লেক মনো মুগ্ধকর অভিরাম বিনোদন
মুুক্তার হাসান, টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ বৃষ্টির বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুরে। বাস্তবে কখনো ট্রেন দেখেনি। তবে শুনেছে অনেক বড় গাড়ি, চলে ‘কু…ঝিক…ঝিক…’ শব্দ করে। ছোট্ট শিশুটির ট্রেন দেখার সাধ কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে টাঙ্গাইল ডিসি লেকে এসে। ছোট্ট ট্রেনে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগও পেয়েছে। টাঙ্গাইল জেলা শহরের ডিসি লেকের শিশু পার্কে খেলনা ট্রেন তাকে মুগ্ধ করেছে। শিশুটির অভিব্যক্তি এর আগে কোনো দিন ট্রেনে উঠি নাই। আজ উঠছি। খুব ভালো লাগছে।’
বৃষ্টির বাবা নিত্যকান্ত দাস জানালেন, টাঙ্গাইল শহরে এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে। ডিসি লেকের কথা আগেই শুনেছেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেখানে বেড়াতে এসেছেন। তিনি বললেন, টাঙ্গাইল শহরে বসার মতো, একটু সময় কাটানোর মতো কোনো জায়গা ছিল না। অবশেষে সেই অভাব পূরণ করেছে ডিসি লেক।
নাগরপুরের শাহজানি গ্রামের কলেজ ছাত্রী আয়েশা সিদ্দিকা সদ্য বিবাহিতা। স্বামীকে নিয়ে ডিসি লেকে বেড়াতে এসে তিনি মুগ্ধ। বললেন, খুব সুন্দর জায়গা। প্রিয়জনকে নিয়ে খানিকটা সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। খুব দরকার ছিল এমন একটা বিনোদন কেন্দ্রের।
টাঙ্গাইল শহরের বাসিন্দা আবু সাইদের মন্তব্য, বিনোদনের কোনো জায়গা না থাকায় এত দিন বিকেলটা কাটাতে হতো উদ্দেশ্যহীন এলোমেলো ঘুরে বেড়িয়ে। ডিসি লেক সেই অভাবটা দূর করেছে। এখন এখানে কিছুটা সময় বেশ ভালো কাটবে।
টাঙ্গাইল শহরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল একটি বিনোদন পার্কের। এর পরিপ্রেক্ষিতে একাধিকবার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি।
অবশেষে টাঙ্গাইলের বর্তমান জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন শহরবাসীর সে প্রত্যাশা পূরণ করতে উদ্যোগী হন। তিনি নিজেই পরিকল্পনা করে শহরের সার্কিট হাউসের পাশে ডিস্ট্রিক্ট লেককে নতুন রূপ দেন। গড়ে তোলেন দৃষ্টিনন্দন পার্ক। ৩৩ দশমিক ৪৫ একর আয়তনের লেক খনন করে তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। কাজ শুরু হয় গত বছরের মে মাসে।
খনন শেষে লেকে ঘাট নির্মাণ ও লেকের মাঝখানে ভাসমান মঞ্চ নির্মাণ করা হয়। এ জন্য ব্যয় হয় দুই কোটি ৯১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ও ব্যক্তি উদ্যোগে আসা অর্থ দিয়ে লেকের পাড় বাঁধা, শিশু পার্কসহ সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হয়। বসানো হয় বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখির মূর্তি। গম্বুজ আকৃতির দ্বিতল ভাসমান মঞ্চটির চারপাশ সাজানো হয়েছে রঙিন সাজে। আর মঞ্চে যাওয়ার রাস্তার দুই পাশে লাগানো হয়েছে রঙিন বাতি। রাতের রঙিন আলোয় লেকের দৃশ্য শহরবাসীকে মুগ্ধ করছে সবাইকে।
প্রতিদিন দুপুরের পর বিশেষ করে বিকেলে বিনোদনপ্রিয় মানুষের ভিড় জমছে ডিসি লেকে। কঠোর শৃঙ্খলার সুবাদে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে। লেকের পানিতে ছোট নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোরও সুযোগ রয়েছে। আছে শিশু পার্ক। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারে এখানে জমছে ব্যাপক ভিড়। শিশুদের সঙ্গে আসছেন অভিভাবকরাও।
টাঙ্গাইলের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি জেলার কবি, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষের কণ্ঠেও উচ্ছাস। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হারুন অর রশিদ বললেন, ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল অগ্রসর জেলা। অথচ এখানে সাধারণ মানুষ ও শিশুদের চিত্তবিনোদনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক উদ্যোগী হয়ে একটি মজা লেককে নান্দনিক রূপ দিয়েছেন। সেখানে বিনোদনের চমৎকার জায়গা তৈরি হয়েছে।
লেকটি সুন্দরভাবে রূপদানের মাধ্যমে টাঙ্গাইলবাসীর অনেক দিনের আশা পূরণ হয়েছে। কবি মাহমুদ কামালের অভিব্যক্তি, ডিসি লেকের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন খুব সুন্দর হয়েছে। তবে বিশাল আয়তনের এই জেলার মানুষের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে এর পরিসর আরো বাড়িয়ে নৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে টাঙ্গাইলবাসী ভীষণ খুশি হবে।
ডিসি লেকের ভাসমান মঞ্চের ভেতরে রয়েছে ফাস্ট ফুডের কয়েকটি দোকান। পশ্চিম পাশেও রয়েছে খাবারের বেশ কয়েকটি দোকান। এখানকার গ্রিন ফুডের স্বত্বাধিকারী আবদুল খালেক শিপন বললেন, টাঙ্গাইলে এ রকম জায়গা আর নেই। শুক্রবারে প্রচুর মানুষের ভিড় হয় এখানে। আগত দর্শনার্থীরা এই উদ্যোগের ব্যাপক প্রশংসা করে। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রাসনের কর্তাব্যক্তিরাও নিয়মিত এখানে আসেন। তাই এখানে নিরাপত্তার অভাব নেই।
জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন জানালেন, তিনি টাঙ্গাইলে যোগদানের পর দেখতে পান যে নির্মল বিনোদনের জন্য, প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো তেমন কোনো জায়গা শহরে নেই। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলাশয় খননের নির্দেশ দেন। তখনই এই লেককে খনন করে বিনোদন পার্ক বানানোর পরিকল্পনা মাথায় আসে। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং বরাদ্দ এনে কাজ শুরু করেন। সরকারি বরাদ্দের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে লেকের পরিধি বাড়ানোর কাজও এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসক হিসেবে নির্ধারিত দায়িত্বের বাইরে তিনি তাঁর সহকর্মী, সাংবাদিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করে ডিসি লেককে পূর্ণাঙ্গ বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ জন্য তিনি প্রায় দিনই বিকেলে অবসর সময় ডিসি লেকে গিয়ে কাটান। খোঁজখবর নেন দোকানদারসহ আগত মানুষের। এই লেককে ঘিরে আরো কিছু পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানালেন জেলা প্রশাসক। বললেন, এখানে ঝুলন্ত ব্রিজ হবে, বসার জন্য আরো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, শিশুদের সাঁতার শেখার জন্য সুইমিং পুলসহ নতুন নতুন আইটেম যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে।