সাহিত্য

স্টুপিড!

stupidশাহরিয়ার রিপন।।

এক.

দুই বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে অর্পা সবার ছোট। বাবা সরকারি চাকুরে।

অর্পাদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল হলেও বাবার সরকারি চাকুরীর কারণে অর্পার পরিবারের সবাই থাকে গাজীপুর। এখানেই একটি কলেজে পড়াশোনা করে অর্পা। এবার সে এইচএসসি পরীক্ষার্থী।

অপরুপা সৌন্দর্যের অধিকারিণী অর্পা মেধাবীও কম নয়। এসএসসিতে এ গ্রেড পেলেও এইচএসসিতে পেয়েছে এ প্লাস। সপ্তদশী বালিকা অর্পার প্রেমে মনে মনে কত ছেলে যে হাবুডুবু খেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু আজ অবধি তার কাছে পাত্তা পায়নি কেউ। দিনের পর দিন হাতে লাল গোলাপ নিয়ে অর্পার জন্য দাঁড়িয়ে থেকেও কেউ বলতে পারেনি ‘আই লাভ ইউ’।

দুই.

স্নাতকে অধ্যয়নরত জয়। সে তার বাবা মা’র একমাত্র ছেলে। তার বড়বোনের বিয়ে হয়েছে মাস কয়েক আগে। আর ছোট দুইবোন পড়াশোনা করে।

একটি ফ্যাক্টরিতে সিকিউরিটি সুপারভাইজারের চাকুরী করা বাবার দিকেই তাকিয়ে তাদের সংসার। জয় দু’একটি টিউশনি করেও কিছু টাকা উপার্জন করে। কিন্তু সেটা একদমই বলার মতো না।

জয় আর অর্পা পৃথক কলেজে পড়াশোনা করলেও তাদের কলেজে যাওয়ার রাস্তা একই। আর তাই প্রায়ই একে অপরের সাথে দেখা হয়ে যায় তাদের। জয় মনে মনে ভীষণ ভালোবাসে অর্পাকে। কিন্তু কোন ভাবেই সমাজের উচু-নিচু ভেদাভেদের এ বাস্তবতাকে ভুলতে পারেনা সে। তার চোখে মুখে প্রতিনিয়তই নিরীহ এক বালকের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে।

মাঝে মাঝে যখন অর্পার দিকে আনমনে চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে, জয়কে নিয়ে হাসাহাসি করতে থাকে অর্পার বান্ধবীদের কেউ কেউ । জয়কে নিয়ে বান্ধবীরা হাসাহাসি করুক- এটা অবশ্য কখনোই চায়নি অর্পা।

তিন.

পড়ন্ত এক বিকেলে বাড়ির পাশে হাটাহাটি করছে অর্পা। এমন সময় তার মোবাইলে মেসেজ…

“আমি জয়। একটা কথা বলতে চাই…”

বেশ কিছুক্ষণ ভেবে অর্পার উত্তর-

“ঠিক আছে বলুন। তবে এমন কিছু বলবেন না যেন আমি মেনে নিতে না পারি”।

এরপর থেকে প্রায়ই চলতে থাকে তাদের মেসেজ দেয়া নেয়া। একপর্যায়ে মোবাইলে কথা বলা শুরু করে তারা। ঘনিষ্ঠতা লাভ করে তাদের সম্পর্ক। এমনকি, কোন এক দিন যোগাযোগ করতে না পারলে স্বাভাবিক থাকতে পারেনা জয়। প্রতিনিয়ত অর্পাকে নিয়ে সে স্বপ্নের রাজ্যে বিচরণ করতে থাকে।

এদিকে পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসে অর্পার। পড়াশোনা নিয়ে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। তা্ই ইদানিং জয়ের সাথে কথা বলা তো দূরে থাক, মেসেজের জবাবও দেয়না।

এরই মধ্যে এক সন্ধ্যায় জয়ের আকুতি-

‘প্লিজ, আমার মেসেজের উত্তর দিবা। আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ…”।

অর্পা কিছুক্ষণ ভেবে জবাব দিলো-

“ঠিক আছে। তবে মাত্র দু্ই মিনিট”।

জয় কোনভাবেই মেলাতে পারেনা তার সেই অর্পাকে। সবকিছু কেন যেন তার কাছে অচেনা লাগে। যে অর্পাকে নিয়ে সে এতটা ভেবে রেখেছে, আজ সেই অর্পাই তাকে এতোটা এড়িয়ে চলছে! চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

জয় কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইলে লিখে পাঠায়-

“ঠিক আছে সোনা। আমিতো দুই মিনিট কথা বলার অনুমতি পেয়েছি। এই দুই মিনিট জমা করে রেখে দিলাম। যদি কখনো খুব দরকার হয়ে যায়, তখন তোমাকে না বলেই দুই মিনিটের জন্য ফোন দিব। প্লিজ, সেই দিন দুই মিনিটের জন্য ফোনটা রিসিভ করো, প্লিজ”।

চার.

জয় আজকাল একদম তার বন্ধুদের সাথে মিশে না। কলেজে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সে জানতে পেরেছে, অর্পার বাবা মা তাদের সম্পর্ক মেনে নিবেনা বলেই অর্পা তাকে এড়িয়ে চলতো। অর্পাকে কোন ভাবেই ভুলে থাকতে পারেনা জয়। আর তাই বাধ্য হয়েই বিদেশ চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। এরই মধ্যে সকল প্রক্রিয়াও শেষ করে ফেলেছে।

স্নাতকে অধ্যয়নরত জয় জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেব মেলাতে না পেরে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে শ্রমিক ভিসা নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে সিঙ্গাপুর। নিজের সব গুছিয়ে নিয়ে বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশনে হাজির জয়। ঠিক এমন সময়ে খুব মনে পড়ছিল অর্পাকে। বুক ফেটে কান্না আসছিল তার। সব স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে আজ সে পাড়ি জমাচ্ছে পরদেশে। চোখ দু’টো ছলছল করছিল তার।

এমন সময় সে মোবাইল হাতে নিয়ে ফোন দিল অর্পাকে।

: সোনা, আমিতো তোমার কাছে দুই মিনিট সময় পেয়েছিলাম কথা বলতে। আর হয়তো তোমার সাথে কথা বলা হবেনা। চলে যাচ্ছি বহুদূর। তাই সেই দুইটা মিনিট তোমার সাথে কথা বলতেই ফোন দিয়েছি। জানো সোনা, তোমাকে আমি অন্নেক অন্নেক ভালোবাসি সোনা। তোমাকে আমার এত্তো এত্তো আদর করতে ইচ্ছে করে। জানি, তুমি আমাকে ভালোবাসোনা। তাই চলে যাচ্ছি। আর হয়তো নাও ফিরতে পারি। আমি চাইনা আমার জন্য তোমার সামান্য কষ্ট হোক। সোনা, পারলে মৃত্যুর পর আমাকে ভালোবেসো।

ঐপাশ থেকে অর্পা কোন উত্তর দেয়ার সুযোগও পাচ্ছিলনা। জয়ের কথা শুনতে শুনতে তার গলাটাও ধরে আসে আবেগে। কী বলবে কিছু খুঁজে পাচ্ছিলনা। কান্না জড়িত কন্ঠে শুধু বলল,

: স্টুপিড! স্টুপিড, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

এটুকু বলতে না বলতেই কান্না শুরু করল অর্পা। সে আর কিছু বলতে পারলনা। অর্পার আবেগঘন কথা শুনে জয় আর কিছুতেই মনকে বেঁধে রাখতে পারলনা। বিমান ছেড়ে যাওয়ার পূর্ব মুহুর্তে সে বিমান বন্দর ছেড়ে ছুটে বের হয়ে গেলো।

এবার তার গন্তব্য সিঙ্গাপুর নয়, গাজীপুর। আজ যে করেই হোক অর্পার কাছে তাকে যেতেই হবে। দৌড়ে ছুটে চলল জয়। কিছুতেই স্থির থাকতে পারছেনা সে। অবচেতন মনে রাস্তায় দাড়ালো সে। মুহুর্তেই ময়মনসিংহগামী এক বাস এসে আঘাত হানল জয়কে। মাথা আর শরীরের ডান পাশটাতে ভীষণ আঘাত পেয়েছে সে।

চারপাশের মানুষজন দৌড়ে তাকে নিকটবর্তী ক্লিনিকে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর চারপাশটা স্তব্ধ হয়ে গেল। ফোনের পর ফোন আসতে লাগলো জয়ের মোবাইলে। ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী ফোনের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত! একে একে বাড়ির প্রায় সবাই চলে আসল। অনেকক্ষণ পর অর্পার ফোন।

কয়েক ঘন্টা না পেরুতেই অর্পা এসে হাজির। কিন্তু জয় আর কথা বলতে পারছেনা। প্রচুর রক্তক্ষরণে এরই মধ্যে সে না ফেরার দেশে চলে গেছে সে। কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত্যুর খবর জানিয়ে দেওয়ার পর থেকেই জয়ের নিকটাত্মীয় স্বজনরা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দেয়।

সবার কান্না আর আহাজারির মাঝে বড্ড বেশি কানে বাজতে থাকে কান্না জড়িত আর্তনাদ “স্টুপিড! স্টুপিড! এই স্টুপিড!!!”

[বেশ কয়েক বছর পর অর্পাকে দেখা গেল টুকটুকে এক মেয়ে কোলে নিয়ে পার্কে ঘুরে বেড়াতে। এটা বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, তার সাথে থাকা যে লোকটির সাথে সে দুস্টুমিতে মেতে উঠছে বারংবার, সে তার স্বামী। দুস্টুমিতে পটু অর্পা- আজও বলে যাচ্ছে, “স্টুপিড! স্টুপিড! এই স্টুপিড!” আজ আর জয় কাছে না থাকলেও, ঐ দূর আকাশ থেকে অবলোকন করছে জয়!]

Email: shahriarrepon2025@gmail.com

Related Articles

Close