ফিচাররাজনীতি

দেশে কি আইন নেই? দেশে কি বিচার নেই?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষকের পিএইচডি থিসিসের ৯৮ ভাগই নাকি কপি করা! বিশ্বাস করুন এই খবর পড়ে আমি মোটেই অবাক হইনি।

আমিনুল ইসলামঃ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর শিক্ষকদের অবস্থা যে ঠিক কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে সেটা বুঝার জন্য গতকাল এবং আজকের প্রথম আলো পত্রিকার দুটো শিরোনাম’ই যথেষ্ট। গতকাল পড়লাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষকের পিএইচডি থিসিসের ৯৮ ভাগই নাকি কপি করা! বিশ্বাস করুন এই খবর পড়ে আমি মোটেই অবাক হইনি। আমার বরং রাগ লেগেছে অন্য কারনে। কপি-পেস্ট করেও যে পার পাওয়া সম্ভব; এই শিক্ষক সেটি জানে না! ঠিক মত রেফারেন্স দিয়ে, একটু এদিক-সেদিক করেও যে পার পাওয়া যায়, এই শিক্ষক সেটাও জানে না! জানবে কি করে! আমার তো ধারণা রেফারেন্স কি জিনিস এই ভদ্রলোক সেটাও জানে না! অথচ গিয়ে দেখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলে হয়ত বিশাল ভাব নিয়ে বেড়াচ্ছে!

আজই পত্রিকায় পড়লাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চার ছাত্রকে পিটিয়ে পুলিশে দেয়া হয়েছে শিবির সন্দেহে। পুলিশ অবশ্য এরপর তাদের ছেড়ে দিয়েছে কারন ওই ছাত্রদের কাছ থেকে পুলিশ এমন কোন তথ্য পায়নি যে তারা শিবির করে। ওরা যদি শিবির করেও থাকতো; তাই বলে তাদের এভাবে মারা যায়? দেশে কি আইন নেই? দেশে কি বিচার নেই? তাছাড়া শিবির কি কোন নিষিদ্ধ সংগঠন? এই আপনারাই তো শিবিরকে আজ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কিনা পুলিশে তুলে দিলো যারা মার খেয়েছে তাদের! যারা ওদের মারল, ওদের কি কোন দোষ ছিল না? নাকি এভাবে যে কাউকে মারা এই দেশের আইনে বৈধ?

বুয়েটে’র ছাত্র আবরারের ঘটনা কি আপনারা এর মাঝেই ভুলে গিয়েছেন? এই হচ্ছে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থা! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা যেখানে এমন, তাহলে ধরে নিন দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর কি অবস্থা! অবস্থা আসলে ঠিক কতোটা খারাপ এটা বুঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দেয়া যাক। নিচের উদাহরণ’টি লিখেছে আমার খুব কাছের প্রিয়জন এবং ভালোবাসার মানুষ। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট এবং গোল্ড মেডেলিস্ট। সে নিয়মিত লেখালেখি করে না। এরপরও লেখাটা যাতে আবেদন না হারায়; এর জন্য আমি তার লেখাটা একদম পুরপুরি তুলে দিলাম। তার এই অভিজ্ঞতার পুরোটা আমি নিজ চোখে কাছ থেকে দেখেছি।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়াতে আবেদন করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেতে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়, সিদ্ধান্ত নিলাম কিছুদিন কুষ্টিয়া শহরে গিয়ে থাকব। এক বন্ধুর কাছে থাকা শুরু করলাম যে কিনা কুষ্টিয়া শহরে বেসরকারি পলিটেকনিকে শিক্ষকতা করত। দুই একজনের সাথে চাকরির বিষয়ে কথা বলতাম আর বিকাল বেলায় শহরের কোথাও আড্ডার মাঝে মাঝে বন্ধুর অফিসে তার কলিগদের সাথে আড্ডা হত। একদিন বন্ধুর অফিসে তার কলিগদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছি যেখানে কিনা আমার এক পরিচিতজন ছিলেন, যিনি কিছুদিন হলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছেন। কথার ফাঁকে আমি বলেই ফেললাম আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য চেষ্টা করতে আসছি। অমনি বন্ধুর কলিগ বললেন

– কাকে কত দিয়েছেন? ভাল ও বিশ্বস্ত লোককে টাকা দিয়েন অন্যথায় টাকা মার খাওয়ার সম্ভাবনা বেশী।

জিজ্ঞেস করলাম

-টাকা কি অবশ্য’ই দিতে হবে?

এরপর বন্ধুর কলিগ ওই সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকের দিকে নির্দেশ করে বললেন।

– ওনার কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারেন। উনি ভাল ভাবে বলতে পারবেন কার কাছে গেলে ভাল হবে আর কোথায় কত দিতে হবে। উনি আরও বললেন- উনার এক পরিচিতজন ১০ লাখের বিনিময়ে চাকরি পেয়েছেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আমি আগে থেকেই জানতাম শিক্ষক হতে বড় অংকের টাকা প্রয়োজন। আমার তো টাকা নেই তাই বলে চেষ্টা করব না! করে’ই দেখি না কি হয়! পরিচিত এক বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম চাকরির ব্যাপারে, উনি বললেন

-তোমার না বিসিএস হয়েছে। তুমি সেখানে যাবে কেন? কেন খামাকা সময় নষ্ট করছ! টাকা ছাড়া ওখানে কেউই কথা বলে না, টাকা দিয়ে শিক্ষক হয়ে তুমি নিজেও শান্তি পাবে না। তাছাড়া সেখানকার পরিবেশ কোন মতেই সুখকর নয়। মাথা থেকে এসব চিন্তা বাদ দিয়ে বিসিএস নিয়ে থাক।

যাহোক, সেই আড্ডায় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, উনাকে একদিন সুযোগ বুঝে জিজ্ঞাসা করলাম। কিভাবে শিক্ষক হয়েছেন? উনার জবাব এমনটাই ছিল- তেমন কোন চাকরি বাকরি পাই নি তাই অনেক কষ্ট করে কয়েকজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে জমি জায়গা বিক্রি করে টাকা দিয়ে এ চাকরিটা হয়েছে। উনি আরও আমাকে জানালেন কোথায় কোথায় গেলে কাজ হতে পারে।

চেষ্টা যখন করতে এসেছি পিছু হাঁটলে হবে না, সামনের দিকে এগুনোই বুদ্ধিমানের কাজ। উনার কথা মত সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নামকরা প্রফেসরের কাছে গেলাম। উনি জানালেন

– এ চাকরি করার জন্য কতজন লাখ লাখ টাকা নিয়ে বসে আছে। আমি তোমার জন্য কেন’ই বা সুপারিশ করব?

নসিমনে করে বাড়ির পানে যাচ্ছি। সঙ্গে ছিলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। অনেক কথা হল উনার সাথে। হঠাৎ করে সেই নসিমনে একজন চাচাকে দেখলাম যার বাড়ি আমাদের গ্রামেই, তিনি অনেকদিন যাবত ব্যাংকে দারোয়ানি পেশায় নিয়োজিত। উনার সাথে কথা বলতে বলতে এক সময় বলেই ফেললাম- আমি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির জন্য চেষ্টা করছি। উনি বললেন

-তোমাকে তো ভাল ছাত্র হিসাবে জানতাম। তুমি কি আর কোথাও চাকরি পাওনি? কেন ভাগাড়ে যেতে চাও?

একটু আশ্বর্য হলাম তবে অবাক হয়নি।

ভাইভার প্রস্তুতি নিচ্ছি। টাকা দেয়নি বলে ভাইভায় যাওয়া যাবে না, এমনটা কোথাও লেখা নেই। নির্দিষ্ট দিনে ভাইভা দিতে গেলাম। ভাইভা গেলে দেখেছি অনেককেই একটু পড়াশুনা করে, একে ওকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে, ভাইভা বোর্ড থেকে কেউ বেরোলে তাকে জিজ্ঞেস করে- ভাই কি জিজ্ঞেস করল? আমি নিজেও এমনটাই করতাম। কিন্তু সেই ভাইভা বোর্ডে প্রার্থীরা একে ওকে জিজ্ঞেস করছেন- ভাই কত দিয়েছেন, কাকে দিয়েছেন, কাজ হবে তো? ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি একটু অবাকই হলাম। একজনের সাথে ভাব জমানোর চেস্টা করলাম। কোথায় বাড়ি, বর্তমানে কোথায় থাকেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন সাথে আরও অনেক কিছু। পরে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করলাম- কাউকে কি টাকা পয়সা দিয়েছেন কিনা? উনার কথাবার্তার ধরণ দেখে হ্যাঁ সুচক জবাব পেয়েছি। পরে অবশ্য উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন

-আপনার এলাকার বর্তমানে দুজন বড় নেতা হানিফ সাহেব কিংবা ইনু সাহেবের সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেছেন কি?

– উনাদের সাথে যোগাযোগ করতে যাওয়ার আগে উনাদের সাঙ্গ পাঙ্গরাই টাকা চেয়ে বসেন? এত টাকা কোথায় পাব বলুন?

শুনেছি উনার চাকরি হয়েছিল। তবে কয়েকদিন চাকরির পিছনে ঘুরে ভাল এক রকম অভিজ্ঞতা হল, তাতেই বা মন্দ কি? চাকরি পেতে কেউ খরচ করেছে ৬ লাখ, কেউ ৮ লাখ, কেউ ১০ লাখ আবার কেউ ১২ লাখ। কারও কারও ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষকের মেয়ের বিয়ে করে। এমনও শুনেছি কাউকে এমন প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল চাকরি পেতে হলে উপাচার্যের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।

এ ঘটনার অনেকদিন পরে গ্রামের দোকানে বসে চা খাচ্ছি। সিনিয়র এক ভাই এসে কৌতুকের ছলে বললেন

-পাশের গ্রামের অমুক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছে। ও সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পায় আর তুমি মিয়া কি কর, ফাস্ট ক্লাস পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাও না। জানো সে কত দিয়েছে

-কত?
-১২ লাখ।
পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন- টাকায় কিনা হয়!

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে পড়ানো খুবই সহজ। অনেককে দেখেছি এসে শুধু চোথা (নোট) দেখে লিখে যান। কে কি বুঝল বা না বুঝল তাতে শিক্ষকের কোন কিছু যায় আসে না। কেউ প্রশ্ন করলে শিক্ষক মশাই রেগে যান। আবার সমাজ বিজ্ঞান কিংবা মানবিক বিষয়ের শিক্ষক হলে, কেউ চোথা (নোট) ধরে এক লাইন পড়ে আর বলে- বুঝছো? সহজ হওয়ার কারণে অনেকে অন্য চাকরি না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা কে বেছে নিয়েছে।

সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছাত্রের সাথে আমার পরিচয় ছিল। তারা কিভাবে তাদের শিক্ষদের মুল্যায়ন করে? অনেকের মতে তারা শিক্ষকদের সালাম দেয় ঠিকই তবে পরক্ষণেই অনেকেই ভাবে- টাকার শিক্ষক।

মাঝে মাঝে ভাবি, টাকা দিয়ে চাকরি নিয়ে আসলে উনারা কি পড়ান! তবে এই ভেবে কষ্ট পাই যে এমন একটা টাকা’র বিশ্ববিদ্যালয় আমার নিজ জেলায় অবস্থিত।

(ঘটনাগুলো ৮.৫ বছর আগের, এখন জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে)

এই হচ্ছে আমার খুব কাছের প্রিয় একজন মানুষের অভিজ্ঞতা।

এবার আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন এই সব শিক্ষকদের ছুড়ে ফেলার সময় এসছে কিনা। যদি আপনারা ছুড়ে ফেলে না দেন; তাহলে একদিন রাষ্ট্র এবং সমাজ হিসেবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এবং মানুষরা আমাদের ছুড়ে ফেলে দিবে।

(ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত)

Tags

Related Articles

Close