মক্সুদা আক্তার প্রিয়তীঃ ‘’আল্লাহ্ প্রিয়তী কিভাবে পারো এইতুকু বাচ্চাদের দিয়ে এতো কাজ করাতে? ‘’
অনুযোগগুলো করেন আদর- ভালোবাসা মমতা ভরা আমার পরিবারের সদস্যরা দেশ থেকে। কন্যা সন্তান থেকে পুত্র সন্তানকে দিয়ে ঘরের টুকিটাকি কাজ করাতে দেখলে উনারা মায়ায় আবেগী হয়ে বেশ মনক্ষুন্ন হোন। আমি বলি,’’ এই ঘর কিন্তু তাদেরও, এই একই ঘরের কাজে হাত বাটানো তাদেরও দায়িত্বের মধ্যে পরে। ‘’ কিন্তু উনাদের আপত্তি বয়সের জায়গাটুকুতে , উনাদের কথা হলো বড় হয়ে করবে। আমার প্রশ্ন হলো বড় হয়ে গেলে কিভাবে একজন মানুষের হঠাৎ করে তার অভ্যাস পরিবর্তন করবে? ততোদিনে তো তার চরিত্র, ব্যাক্তিত্ব, জীবনযাপনের শৃংখলা, পারিবারিক প্রাথমিক শিক্ষা, মূল্যবোধ, নীতি ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে অলরেডি ফর্মড হয়ে যায়, ১৬ বছর পর তার ভিতর আমুল পরিবর্তন কিভাবে আনবেন?
আবরাজ এবং মৌনীরা, তাদের ৬/৭ বছর বয়স থেকেই ঘরের কাজে আমাকে টুকটাক সাহায্য করে। এটি এমন নয় যে, ওরা নিজ থেকেই করা শুরু করেছিলো। আমার তাদের ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে ট্রেইন করতে হয়েছে। বোঝাতে হয়েছে, এই ঘর আমাদের সবার, সবাইকেই ঘরের কাজে অবদান রাখতে হয়, একজনের উপর চাপিয়ে না দিয়ে। ঘরের কাজগুলো এমন, ঘুম থেকে উঠেই নিজের বিছানা গুছিয়ে ফেলা, খাবারের পর নিজের থালাটা ধুয়ে ফেলা, ফ্লোরের উপর কিছু ফেললে সঙ্গে সঙ্গে ব্রাশ দিয়ে উঠিয়ে ফেলা, খেলার পর নিজের খেলনা গুছিয়ে রাখা, কাপড় ধোয়া থাকলে তা ছড়িয়ে দেয়া, বা শুকনা কাপড়গুলো ভাঁজ করে ফেলা, নিজের কাপড় গুলো আলমারিতে জায়গামত রাখা, বাসায় পেপার বিন থাকলে রিসাইকেল বিনে ফেলা ইত্যাদি। আহামরি কোন কাজ নয়। ওরা কাজগুলো শেষ করার পর কিন্তু আমাকে ওদের আড়ালে আবার করতে হয়, কারণ ছোট্ট ছোট্ট হাতে তো পারফেক্টলি এগুলো করতে পারে না , তাইনা? এখন প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে বাচ্চাদের দিয়ে কাজ করিয়ে কি লাভ? লাভ হচ্ছে, তাদের অভ্যস্ততা, নিজ ঘরের কাজের প্রতি দায়িত্বগুলো বুঝে নেয়া, নিজেদেরও এর অংশ মনে করা।
২/৩ বছর আগের থেকে শুরু করা, আমার ছেলে সন্তানকে দেখতে পাই, সে জানে তার প্রতিদিনের টাস্ক কি, তাকে এখন আর আমাকে বলে দিতে হয়না। ঘরের কোন কিছুতে হাত বাড়াতে বললে, নাক উঁচু করে আলসেমি দেখায় না, সে জানে তার দায়িত্ব, কারণ সে একই পরিবারের সদস্য। তবে যদিও চোখ কান খোলা রাখে, মৌনীরাও একই ভাগে কাজ করে কিনা, নাকি একাই কাজ করছে … হাহাহা টিপিক্যাল ভাইবোন প্যাচাল।
মনে পড়ে হুমায়ূন আজাদ বলেছিলেন, ‘’ ছেলেটি তার বিছানা গুছিয়ে না রাখলে মা খুশি হয়, দেখতে পায় একটি পুরুষের জন্ম হচ্ছে; কিন্তু মেয়েটি বিছানা না গোছালে একটি নারীর মৃত্যু দেখে মা আতংকিত হয়ে পড়ে ।‘’
এইযে পারিবারিক ব্যাকারনের চক্র/সাইকেলটি ভাঙ্গতে হবে, এবং তা মায়েদের ভাঙ্গতে হবে। আমরা আমাদের সন্তানদের বেশী আদর স্নেহ, আদর, যত্ন ভালোবাসায় আবৃষ্ঠ করতে গিয়ে সন্তানদের যে সাধারণ শৃঙ্খলা বা দায়িত্ব শিখানো দরকার সেটিই ভুলে যাই, গড়ে তুলি নিজ হাতে পরনির্ভরশীল প্রাণী হিসেবে। বিশেষ করে ছেলে সন্তানদের বেলায়। দাম্ভিকতার সাথে বড় গলায় বলতে থাকি, ‘’ আমার সন্তান কাজ করবে? আমি তার জন্য দশটা কাজের লোক রাখবো।‘’ অনেক সন্তানেরা বড়াই করে বলে,’’ আমি কখনো একটা গ্লাসে পানি ঢেলেও খাইনি, এতোটা মাথায় তুলে রাখতো ।‘’ Unfortunately they were wrong, you have two active arms and you could not use them because of their love or your laziness or they want to make you lazy? উনাদের অতিরিক্ত কেয়ার বরং আপনার শারিরীক স্ট্রেন্থ কমিয়ে দিচ্ছে তা রিয়েলাইজ করতে পারেন না আসলে। আর আপনি বুঝতে পারেননা, আপনি কাজ না করতে করতে আপনার শরীরের কলকব্জাগুলোতে ঝংকার ধরিয়ে ফেলছেন।
সন্তানদের বয়স ১৬/১৭ বছর হয়ে যায়, তখন আর কোনকিছু বলে লাভ হয় না, তারা ততোদিনে অগোছালো জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পরে। মা হয়তো তখনও কাজ করে দিচ্ছেন দামড়া ছেলেটার। আর দিনকে দিন এভাবেই মা নিজের হাতেই মমতার নাম দিয়ে, নিজের দৈননিন্দ কাজকে কঠিন করে, নিজের জীবনের আনন্দের বা অবসরের সময়গুলোকে বিসর্জন দিচ্ছেন, এতেই সুখ পাচ্ছেন বলে মেনে নিচ্ছেন, দাবীও করছেন।
কিন্তু আপনার ছেলে এই জীবনযাপনে এতোই অভ্যস্ত হয়ে পরে যে এটাই স্বাভাবিক বলে সীল-মোহর লাগিয়ে নেয় কারণ এই আরামের জীবন কে না চায়? এই যে তার সব ঘরের কাজ পরিবারের নারী সদস্যরাই করবে। লক্ষ্য করুন, আপনার ছেলে সন্তানটি শুধুমাত্র নারী সদস্যদের কথাই ভাবছে। আর এভাবেই ছেলে সন্তানদের মনস্তাত্ত্বিক গঠনগুলো দিনের পর দিন একই চক্রের মধ্যে ঘুরতে থাকে। এভাবে কাজও জেন্ডারাইজড হতে থাকে।
আপনার ছেলে বড় হতে থাকে, তাকে বিয়ে দিবেন এবং তার জন্য খুঁজতে থাকেন আপনারই মতো আরেকজন এডাল্ট বেবি সিটার। আপনার ছেলের জন্য ঐ একই কাজ যে করবে যা আপনি এতো বছর ধরে করে এসছেন। অর্থাৎ আপনি নিজের মমতা ভরা হাতেই ফর্মড করা একজন সন্তান যে অগোছালো , পরনির্ভরশীল, অলস , দায়িত্বহীন নিজ কাজের অংশে।
আবরাজ মাঝে মাঝে আমার এবং তার বোনের মাথায় তেল দিয়ে দিতে বলি। আমাকে দেয়ার সময় কোন রকমের টু শব্দ না করলেও বোনের মাথায় দেয়ার সময় কু-কা করে শেষ পর্যন্ত দিয়ে দেয়। যদিও সেইদিন আমার মাথার অর্ধেক চুল তালু থেকে গায়েব হয়ে যায়। এই কাজটিতে ওর ইনভল্ভমেন্ট করানোরও একটি ছোট্ট কারণ রয়েছে। কারণটা কি হতে পারে সেটির উত্তর আপনাদের মুখ থেকে শুনতে চাই, জানতে চাই আপনাদের ভাবনা গুলো।
একটা কথা কি জানেন ? যে নিজ ঘরকে অর্গানাইজলি সার্ভ করতে পারে, তখনই সে দেশকে অর্গানাইজড ভাবে সার্ভ করতে পারবে। শুরুটা শুরু হয় ঘর থেকেই।
বিঃদ্রঃ এখানে আমি মহান মা কিংবা আমার সন্তানেরা বেস্ট সন্তান তা প্রমাণ করতে এই লেখা নয়। মানুষ মাত্রই ত্রুটিপূর্ণ। আমাদের দেশের পারিবারিক সংস্কৃতিতে কিছু খাঁদ রয়েছে, মনে হয়েছে পরিবর্তন আসার দরকার যার মুখ্য ভুমিকা পালন করতে হবে আমাদের মায়েদেরই।
আমার সন্তানেরা দশবছর পর কেমন মানুষরূপে পরিণত হয়, আমার জানা নেই। তবে আমার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে, একাডেমিক কোয়ালিফিকেসন থেকে একজন ভালো মানুষরুপে গড়ে তোলা।
পরিবর্তনের শুরু নিজ ঘর থেকেই
ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত