অন্যান্য
বিয়ের জৌলুসের বাজারজাতকরণ এবং তার বিপদ!
আর. এস. লীনা: একবিংশ শতকের গোড়ার দিকেও বিয়েটা কেবলই ছিল পারিবারিক উৎসবের একটা উপলক্ষ্য। হলুদ, মেহেদী বা বিয়ের অনুষ্ঠানটা ছিল পরিবারের বা পাড়ার সবচেয়ে শিল্পমনস্ক মেয়েদের ও ছেলেদের হাতের পারদর্শিতা প্রমাণের একটা জায়গা। রাত জেগে, হৈহুল্লোর করতে করতে কাজ করত তারা। উপকরণ ছিল পাটায় বাটা মেহেদী পাতার মেহেদী, হলুদ, প্রতিবেশীদের বাগানের ফুল(অনেক ক্ষেত্রে চুরি করা), তিব্বত স্নো, আলতা, লাল বেনারসী ইত্যাদি। বর মূলত তার সবচেয়ে ভাল এবং অপেক্ষাকৃত নতুন পাঞ্জাবীটা ধূঁয়ে নীল ও মাড় দিয়ে আয়রন করে পরত। বাকী মেহমানরাও তার ব্যতিক্রম নয়, শুধু কনের জন্যই কয়টা নতুন কাপড় বরাদ্দ থাকত, সাথে কিছু গয়না। এগুলো ছেলেপক্ষের সামর্থ অনুযায়ী দেবারই চল ছিল। তা যাই হোক না কেন তাতে প্রাণ ছিল, ভালবাসা ছিল, কষ্টে অর্জিত গৌরবের অহংকার ছিল।
এখন দিন পাল্টে গেছে, এখন সব সহজলভ্য। টাকা পকেটে থাকলেই হল, কেল্লা ফতে। এখন বিয়েতে শুধু কনের জন্যই শপিং হয়না। অনুষ্ঠানে আগত প্রায় সবার জন্যই পোশাক কোড মেনে পোশাক, গহনা, ব্যাগ, সেন্ডেল জুতো কেনা হয়। অনেক বিয়েতে কনে পক্ষ ও বর পক্ষের জন্য পোশাকের কালার কোডেরও চল আছে। আবার বিয়ে বিভিন্ন প্রকারভেদও আছে। যেমন ওয়েডিং ডেস্টিনেশন! এখন ওয়েডিং ফটোগ্রাফি খুব জনপ্রিয়। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত কেউ ই কম যান না! বিয়েতে কে কত শোঅফ করবে এটাই তাদের মূল লক্ষ্য।
বিয়ে কি? তার গুরুত্ব একজন মানুষের জীবনে কতটা? এসব না জানলেও বিয়ের সজ্জা নিয়ে নারীদের মধ্যে তমুল উৎসাহ থাকে। বউ সাজার উৎসাহে বিয়ে নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি তাদের থাকে না। ফলে বিয়ের পরে তারা হঠাৎ অকূল পাথারে পরে যায়! অনেকটা স্বপ্নে দেখা রুপকথার জগৎ থেকে বাস্তব জীবনে জেগে ওঠার মত। বিয়ে পরবর্তি
জীবনে জটিলতা শুরু হয়ে যায় হানিমুন শেষ হতে না হতেই।
অন্যদিকে যুগের সাথে তাল মেলাতে, মেয়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য ও ছেলেপক্ষের শখ আহলাদ পূরণ করতে যেয়ে মেয়ের পরিবারকে মোটামুটি সর্বশান্ত হতে দেখা যায় সচারাচর! ছেলের বাড়িতে গিফট(যৌতুকের সুশীল নাম) দিতে দিতে, মাথা হেঁট(কনে পক্ষের চোখ মাটির দিকে না রাখলে বরের ইজ্জ্বত এর ফালুদা হয়ে যায়) রাখতে রাখতে কনের বাবা-মা আর সোজা হতে পারে না!
প্রশ্ন হলঃ বিয়েতে এত জৌলুসের আদতে কোন প্রয়োজন আছে কি? নাকি এ শুধু অর্থের অপচয়! গিফটের নামে, নজরানার নামে, বিয়ে উৎসবের নামে দু’পক্ষের উপর চাপিয়ে দেয়া সমাজ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খরগ বৈ তো কিছু নয়। সরল কথায় এ শোঅফ শুধু টাকার শ্রাদ্ধ! এতে যেমন দুপক্ষের পারস্পরিক সম্মান ও ভালবাসা বাড়ে না, তেমনি আন্তরিকতাও তৈরী হয় না। বরং অনেকক্ষেত্রে সম্পর্কের তিক্ততা বাড়ে। প্রীতির সম্পর্ক হয়ে যায় সাপে নেউলে।
এর প্রধান কারণ হল বিয়ের বাজারজাতকরণ। বিয়ে তার পরিবারিক গন্ডি ছেড়ে আজ ব্যবসায়িক গন্ডিতে এসে দাড়িয়েছে। আর এতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে মিডিয়া। বিয়ের অনুষ্ঠানকে রাজকীয় করাটা তাদের একটা ব্যবসায়িক পলিসি ছাড়া কিছু নয়। তারা জমকালো বিয়ের স্বপ্ন বুনছে কিশোর ও তরুন মনে।
একদিকে বউ সাজাটাকে বাজারজাত করা হচ্ছে। অন্যদিকে বলা হচ্ছে বউ সাজাটাই যেন মেয়েদের স্বপ্ন না হয়ে ওঠে! বড় আজব দুনিয়া!!!