জাতীয়সর্বশেষ নিউজ

আবারও বসুন্ধরা সিটিতে অগ্নিকান্ড

bosundhoraনিউজরুমবিডি ডেস্কঃ বিকেল পাঁচটা। ফোনের অপর প্রান্তে এনায়েত হোসেন। তিনি ফায়ার ব্রিগেড অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (নিয়ন্ত্রণ কক্ষ)। তিনি বসুন্ধরার অগ্নিকাণ্ডের দিকে নজর রাখছিলেন। শুনলাম ফায়ার ব্রিগেডের ২৯টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে অংশ নিয়েছে। এখনো দুর্ঘটনার বিস্তারিত কারণ জানা যায়নি। তবে ধারণা করা চলে, বসুন্ধরার বারবার অগ্নিকাণ্ডও প্রমাণ রাখছে যে তাদের নিজস্ব ব্যবস্থা কাজ করেনি।

২০০৯ সালের ১৩ মার্চে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে প্রথম আগুন লাগে। তখন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, তার মানে দাঁড়ায় বিশ্বের উন্নত দেশেও বহুতলবিশিষ্ট শপিং মল বা ভবনে আগুন নেভানোর কাজ প্রাথমিকভাবে সরকারি দমকল বাহিনী করে না।

এটা প্রধানত সংশ্লিষ্ট ভবনের নিজস্ব ব্যবস্থার আওতায় করার কথা। বিশেষ দরকার পড়লে সেটা আলাদা। ড. চৌধুরী উল্লেখ করেন, লো রাইজ ভবনে (নয়-দশতলা) আগুন লাগলে তা নেভাবে দমকল বাহিনী। ১০ তলার বেশি ভবনে আগুন লাগলে তার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ভবন কর্তৃপক্ষের। আর বসুন্ধরা ১৯তলা ভবন—যার ৮তলা মল, আর বাকিটা করপোরেট হেডকোয়ার্টার্স।

অধ্যাপক জামিলুর রেজার কথায়, বসুন্ধরার মতো বহুতল বৃহৎ ভবনে একটা নিজস্ব ফায়ার সেফটি প্ল্যান থাকবে। আগুন লাগলে এটা কীভাবে ম্যানেজ করা হবে, তার জন্য একটা দল সার্বক্ষণিকভাবে দায়িত্বে নিয়োজিত থাকার কথা। কর্মী বাহিনীকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া থাকবে, কোন ফ্লোরে কার কী দায়িত্ব। এ ধরনের ঘটনা কালেভদ্রে ঘটলেও এর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত দলকে সার্বক্ষণিক সজাগ থাকতে হবে।

এ জন্য দুটি জিনিসের নিশ্চয়তা থাকা দরকার। আমাদের বিল্ডিং কোডে বলা আছে, নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর প্রথম দুই বছর প্রতিবছর চারবার অগ্নিনির্বাপণ মহড়া করতে হবে। তৃতীয় বছর থেকে বছরে দুবার করে ফায়ার ড্রিল বা অগ্নিনির্বাপণ মহড়া করতে হবে।

হয়তো দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হলো বিদ্যমান স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কি আমাদের দেশের বহুতল ভবনগুলোতে সক্রিয় আছে কি না। দেশের অন্য কোনো বহুতল ভবনে আগুন লাগলে কেন তা কাজ করবে, সে বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার হওয়া দরকার।

গণমাধ্যমকে এখন একটা বিরাট দায়িত্ব পালন করতে হবে এ বিষয়ে রিপোর্ট করে। যেমন সারা দেশের সংবাদদাতারা এখন মনোযোগ দেবেন যে বহুতল ভবনের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থা কতটা কী কাজ করছে বা করছে না। তারা নিয়মিত মহড়া দিচ্ছে কি দিচ্ছে না। বাণিজ্যিক ভবনে দুই বা ততোধিক সিঁড়ি থাকতে হবে।

তাছাড়া সিঁড়িগুলো এমনভাবে সুরক্ষিত থাকতে হবে, যেন আগুন লাগলে সিঁড়িতে ধোঁয়া না আসতে পারে। কারণ, সিঁড়ি দিয়েই তো প্রাথমিকভাবে বেশির ভাগ মানুষ নেমে আসবে। সে জন্য সিঁড়ির ডিজাইনও একটি স্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া উচিত। এখন সরেজমিন রিপোর্ট করতে হবে যে এগুলো মানা হচ্ছে নাকি হচ্ছে না।

১৯৯২-৯৩ সালে প্রণীত ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের (বিএনবিসি) আইনগত বাধ্যবাধকতা আনতে প্রায় ১৩ বছর সময় লাগে। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো গেজেট হয়। ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় এটা অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। কেউ যদি তা না করে, তাহলে তা বেআইনি হবে।

আমাদের একটা প্রবণতা হলো সরকারি খাতের কোনো ‘বেআইনি’ বিষয়কে যতটা সংবেদনশীলতার সঙ্গে দেখা হয়, বেসরকারি খাতের সেভাবে দেখা হয় না। কিন্তু বিপদের সময় সরকারকেই তুলোধুনো করা হয়। যেমন বসুন্ধরার অগ্নিকাণ্ড বাগে আনতে যদি ফায়ার ব্রিগেড ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা যতটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করব, বসুন্ধরার বা বেসরকারি খাতের কোনো ব্যর্থতা নিয়ে আমরা তুলনামূলক হইচই কম করব। এটা দায় বা দোষারোপ স্থানান্তরের জন্য নয়, আত্মজিজ্ঞাসার জায়গা থেকে দেখতে হবে।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে বসুন্ধরায় ৭তলা পুড়ে ছাই হয়েছিল। নিহত হয়েছিলেন চারজন। আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করা হয়েছিল ২০০ কোটি টাকা।

ফখরুদ্দীন একজন অভিজ্ঞ দমকলকর্মী। তিনি রোববার দিনভর নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সক্রিয় ছিলেন।তিনি বললেন, অনেক নামীদামি ভবন রয়েছে, যাদের নিজস্ব অত্যাধুনিক আগুন নেভানোর ব্যবস্থা আছে, কিন্তু প্রয়োজনের সময় সেটা কাজ দেবে কি না, তা হলফ করে বলা যায় না।

এই যদি বাস্তবতা হয়, তাহলে কোনো প্রতিষ্ঠানে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা থাকল আর থাকল না, এর মধ্যে কী তফাত হলো। সরকারের ফায়ার সার্ভিসকে না ডেকেই বড় ধরনের কোনো অগ্নিকাণ্ড নির্বাপণ করার মতো সামর্থ্য কবে অর্জন করবে আমাদের দেশের বেসরকারি খাতের বহুতল ভবনগুলো?

জামিলুর রেজা চৌধুরী সাত বছর আগে যা বলেছিলেন, তারই কি পুনরাবৃত্তি চলতে থাকবে? আমাদের কি কোনো হুঁশ হবে না? তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে যখন অগ্নিকাণ্ডের বড় ধরনের ঘটনা ঘটে, তখনই কেবল সবাই নড়েচড়ে বসে; সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু হয়। আবার তা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। যেমন, এনটিভি ভবনে দুর্ঘটনা ঘটার পর সবার মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহ দেখা গেল, অনেক প্রতিষ্ঠানে ফায়ার ড্রিল হলো। কিন্তু কিছুদিন পর সব থেমে গেল। পরবর্তী সময়ে কারও মধ্যে আর এ বিষয়ে আগ্রহ দেখা গেল না।’

২০০৯ সালে বসুন্ধরার বসুন্ধরা সিটির অন্যতম স্থপতি মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ এক নিবন্ধে বলেছিলেন, ‘আগুন নেভানোর আধুনিক সব সুবিধা বসুন্ধরায় ছিল। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে শিক্ষা এখান থেকেই নিতে হবে। আসলে বড় ভবনগুলোতে আগুন লাগার পর কী করতে হবে, এ জন্য পূর্বপ্রস্তুতি থাকা দরকার।

এ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ ও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের ব্যবহার জানতে হবে এবং মাঝেমধ্যে মহড়াও দিতে হবে। ঢাকা শহরে এ ধরনের অনেক উঁচু ও বিশাল ভবন রয়েছে। এসব ভবনে বিশ্বমানের সুবিধাও রয়েছে। কিন্তু সেসব সুবিধার ব্যবহার নিশ্চিত করাটা জরুরি। এ জন্য ভবনের নিজস্ব লোকদের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে একটা সমন্বয় থাকা দরকার। এ ক্ষেত্রে বছরে দু-একবার সমন্বিত মহড়া দেওয়া হলে বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।’

বসুন্ধরার দ্বিতীয় অগ্নিকাণ্ড থেকে আমরা এ শিক্ষাই নেব, যে শিক্ষা আমরা আগে নিতে উৎসাহী ছিলাম না। আমরা মনে রাখব, বসুন্ধরার দুর্ভাগ্যজনক আগুন থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং তা কেবল বসুন্ধরার জন্যই নয়; দেশের সব বহুতল ভবনকেই একেকটি ওয়েক আপ কল হিসেবে দেখতে হবে।

উক্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরের গড় করলে দেখা যায়, আমাদের দেশে বছরে ১৭ থেকে ১৮ হাজার অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ২০১৫ সালে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৮৫৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।

আর দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের জাতিকে এখন থেকেই অধিকতর সতর্ক হতে হবে। কারণ, ভূমিকম্প ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের জনগোষ্ঠীকে আরও বেশি লড়াকু হতে হবে। জাতি হিসেবে আমাদের তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে কী করে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়, তা রপ্ত করতে হবে।

শুনেছি, জাহিদ নামের এক প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণ বছর চারেক আগে দুচোখে স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি বার্মিংহামে রোলস রয়েসে কাজ করেন। তিনি আগুন নেভানোর কাজে ড্রোন ব্যবহার-সংক্রান্ত একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে উদ্যমী ছিলেন। কিন্তু তিনি ছয় মাস ফায়ার ব্রিগেডসহ এদুয়ার থেকে ওদুয়ারে ঘুরে বিফল মনোরথে ফিরে যান।

Tags

Related Articles

Close