বাংলাদেশ
দুর্নীতি আর লুটপাটের ব্যাপক অভিযোগে ঝিনাইদহ সওজ
মোঃ জাহিদুর রহমান তারিক, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি : লুটপাটেরও একটা সীমা আছে, কিন্তু ঝিনাইদহ সড়ক ও জনপথ বিভাগে যেনো কোন সীমা পরিসীমা নেই। যেনতেন কাজ করে সরকারী টাকা পকেটস্থ করাই যেন দপ্তরটিতে মুখ্য বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। রাস্তা উন্নয়নে বরাদ্দ টাকা কাজ না করেই লুটপাট হচ্ছে। ফলে ঝিনাইদহের বিভিন্ন স্থানে নতুন ভাবে করা রাস্তা দ্রুত খানাখন্দকে ভরে গেছে। দরপত্রের শর্তাবলী পুরণ না করে একেবারেই মানহীন ভাবে রাস্তা তৈরী করায় কোন কোন রাস্তা ১৫ দিনেই নষ্ট হয়ে গেছে। এ নিয়ে ভাঙ্গা রাস্তার ছবি সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। সমালোচিত হচ্ছে কাজের মান নিয়ে।
প্রধানমন্ত্রী, দুর্নীতি দমন কমিশন ও সড়ক মন্ত্রানলয়ে পাঠানো অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ঝিনাইদহ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সেলিম আজাদ খান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম ও যশোরের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুরুজ মিয়া এই লুটপাটের সাথে জড়িত। তাদের যোগসাজসে ঠিকদাররা মানহীন কাজ করতে সক্ষম হয়েছে। ঝিনাইদহ শহরের ব্যাপারীপাড়ার রবিউল ইসলামের ছেলে সৈয়দ রেজাউল ইসলাম রাজু দুর্নীতি দমন কমিশন যশোর জোনের উপ-পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, কাজ পাইয়ে দিত ৭% ও কাজের কার্যাদেশ দেওয়ার সময় ১০ থেকে ১৫% করে টাকা আদায় করা হয়েছে। আবার যে সব রাস্তায় দায়সারা ভাবে কাজ করা হয়েছে সে সব রাস্তার চুড়ান্ত বিল উত্তোলনের সময় ঠিকাদার ৬০% ও অফিস ৪০% করে টাকা ভাগাভাগি করা হয়েছে। এই ভাগাভাগির ফলে ২০১৬/১৭ অর্থ বছরে একই ঠিকাদার ৮/৯টি করে কাজ পেয়েছেন।
ঝিনাইদহ সওজ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, গত অর্থ বছরে জেলায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা রাস্তা উন্নয়নে ব্যায় করা হয়েছে। প্রকল্পের টাকা কাজ না করে ফেরৎ দেওয়া হয়ে সাড়ে তিন কোটি। অন্যদিকে জেলাজুড়ে সড়কে বড় বড় গর্ত আর খানাখন্দক রেখেই রক্ষনাবেক্ষনের ৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকাও ফেরৎ দেওয়া হয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে রাস্তা মেরামত বা নির্মানের সর্বোচ্চ এক মাসের মাথায় ভেঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। এমন একটি রাস্তা হচ্ছে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়ক। প্রিয়ডিক মেইটেন্স প্রগ্রামের (পিএমপি) আওতায় এই সড়ক উন্নয়নে ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যায় করা হয়। ৪.৮ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে ঝিনাইদহ শহরের আলহেরা বাসষ্ট্যন্ড এলাকায় ৭০০ মিটার, তেতুলতলা এলাকায় ৪০০ মিটার, বিষয়খালী এলাকায় ৯০০ মিটার ও কালীগঞ্জ কলার হাট থেকে উপজেলার গেট পর্যন্ত ৪০০ মিটার। অথচ এই সড়কের কালীগঞ্জ উপজেলার খয়েরতলা বাকুলিয়া স্থানে ১৫ দিনের মধ্যে রাস্তাটি ভেঙ্গে যায়।
দরপত্রের শর্ত না মেনে যেনতেন ভাবে করার করণে এমনটি হয় বলে অভিযোগ। এদিকে রক্ষনাবেক্ষন প্রকল্পের আওতায় করা ঝিনাইদহ-যশোর সড়কের কালীগঞ্জের মোবরাকগঞ্জ চিনিকল এলাকায় ৩২ লাখ ২০ হাজার টাকা ব্যায়ে ১২’শ মিটার, একই সড়কের খড়িখালী দোকান ঘার থেকে ছালাভরা পর্যন্ত ৫৩ লাখ টাকা ব্যায়ে ১২’শ মিটার, ২৭ লাখ টাকা ব্যায়ে পুলিশ লাইন, ঝিনাইদহ বাস টার্মিনাল ও আপরাপপুর ইন্টার সেকশন, ঝিনাইদহ কুষ্টিয়া সড়কের চড়িয়ারবিল থেকে শেখপাড়া বাজার পর্যন্ত ৪৯ লাখ ১৩ হাজার টাকা ব্যায়ে ৬৬৮ মিটার ও আশ্রয়ন প্রকল্প থেকে গাড়াগঞ্জ নায়ের আলী জোয়ারদারের তেল পাম্প পর্যন্ত ৬৭ লাখ ৬ হাজার টাকা ব্যায়ে ১৫৫০ মিটার রাস্তা মজবুতিকরণ, কার্পেটিং ও সীলকোট দ্বারা করা হয়।
মেহেরপুরের মল্লিকপাড়ার জহিরুল ইসলামের লাইসেন্সে চারটি কাজ করেন কুষ্টিয়ার লাল মিয়া। এ সব রাস্তা পরিদর্শন করে দেখা গেছে চড়িয়ারবিল থেকে শেখপাড়া বাজার পর্যন্ত রাস্তা সীলকোট করার এক মাসের মধ্যে বড়বড় (পটহোলস্) গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ঠিকাদারের তত্বাবধানে থাকা নষ্ট হওয়া এ সব রাস্তা গত শনিবার ( ১৫ জুলাই) ঝিনাইদহ সওজ বিভাগ থেকে পাথর, পিচ রোলার, লোকবল ও গাড়ি ব্যবহার করে তড়িঘড়ি করে মেরামত করতে দেখা গেছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, খালিশপুর-মহেশপুর-দত্তনগর-জিন্নানগর-যাদবপুর সড়ক উন্নয়নেও পুকুর চুরির ঘটনা ঘটেছে। আগে ৫০ মিলি পাথর দিয়ে কার্পেটিং করার পর ১২ মিলি পাথর দিয়ে সীলকোট করার বিধান থাকলে তা করা হচ্ছে না। কোন কোন রাস্তায় আইটেম কমিয়ে শুধু সীলকোট করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার আমতলা-তৈলটুপি-আলমডাঙ্গা সড়ক উন্নয়নে ইজিপি টেন্ডার-২৭ এর আওতায় ২ কোটি এক লাখ টাকা ব্যায় করা হয়। ওই সড়কে ৫২১৭ মিটার রাস্তা নির্মান করা হয়েছে।
খুলনার মোজাহার এন্টারপ্রাইজ কাজটি করেন বলে কাগজ কলমে দেখানো আছে। কিন্তু কাজ করেছেন ঝিনাইদহ সড়ক বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম। তিনি যেনতেন ভাবে কাজ করে জুনের আগেই বিল তুলে নিয়েছেন। এই সড়কে গর্ত মরামত করে ৫০ মিলি পাথর দিয়ে কার্পেটিং করার পর সীলকোট করার নিয়ম ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। রাস্তার পাশে মাটিও দেওয়া হয়নি। ফলে কাগজ কলমে কাজ করার পরও সরেজমিন কাজের তেমন আলামত মিলছে না। বাংলার পরিবর্তে কমদামের ইরানী পিচ ব্যবহার করার ফলে রাস্তাগুলো অল্প দিনে নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া শৈলকুপা, মহেশপুর ও কাীগঞ্জের অনেক স্থানে কাজ না করেই বিল তুলে নেওয়া হয়েছে। যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে। অর্থ লোপাটের বিষয়ে ঝিনাইদহ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সেলিম আজাদ খানকে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।
যশোরের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুরুজ মিয়া জানান, এ সব কাজের দায় আমার নয়, আপনি নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে কথা বলুন। অথচ এ সব ভুয়া বিল উত্তোলনের সময় সুরুজ মিয়াকেও সাক্ষর করতে হয়েছে। সুরুজ মিয়া বিলে সাক্ষর করেন না বলে সাংবাদিকদের সাফ জানিয়ে দেন। তবে এ সব কাজের সুপারভেশনে থাকা ঝিনাইদহ সড়ক বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম জানান, কাজের পরপরই বর্ষার কারণে রাস্তা দ্রæত নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন কালীগঞ্জের খয়েরতলা বাকুলিয়া নামক স্থানে নিচে হেরিং সলিং থাকার কারণে রাস্তা টেকানো সম্ভব হয়নি। বিষয়টি আমরা তদন্ত করে মন্ত্রনায়ে রিপোর্ট দেব। কোটি কোটি টাকা ব্যায় করে নির্মিত রাস্তা কেন দ্রæত নষ্ট হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, আমি নিজেও বুঝতে পারছি না কেন এমন হচ্ছে। তিনি লুটপাটের বিষয়টি এড়িয়ে বলেন, এখন ঠিকাদারী কাজে লাভ বেশি। দরপত্রে পিচের প্রতি ব্যারেল দাম ধরা ১১ হাজার। বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ৬ হাজার টাকায়।