বাংলাদেশসর্বশেষ নিউজ
কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের মৃৎশিল্প
মুক্তার হাসান, টাঙ্গাইল থেকে, নিউজরুমবিডি.কম: মৃৎশিল্পীরা ভালোবাসা ও মমতা দিয়ে সুনিপুন হাতে কারু কাজের মাধ্যমে মাটি দিয়ে তৈরি করে থাকেন নানা তৈজসপত্র। তাদের জীবন জীবিকার হাতিয়ার হলো মাটি। কিন্তু কালের বিবর্তনে তাদের ভালোবাসার জীবিকা ফিকে হতে বসেছে। দিন যতই যাচ্ছে, ততই বাড়ছে আধুনিকতা। আর এই আধুনিকতা বাড়ার সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির তৈরি শিল্পপণ্যগুলো। এক সময় মাটির তৈরি তৈজসপত্রের প্রচুর ব্যবহার ছিল। সেই তৈজসপত্রের স্থান দখল করে নিয়েছে এ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের তৈরি তৈজসপত্র। এসবের দাম বেশি হলেও অধিক টেকসই। তাই টাকা বেশি হলেও এসব তৈজসপত্রই কিনে থাকে সাধারণ মানুষ। কাঁচ, প্লাস্টিক আর মেলামাইনের ভিড়ে এখন মাটির তৈরি ঐ জিনিসপত্রগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছেনা।
জানা যায়, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার ফলদা কুমার পাড়ায় ২০০টি কুমার পরিবার বাস করছে। এর মধ্যে ৮০টি পরিবার সরাসরি মৃৎ শিল্পের উপর নির্ভরশীল। দিনরাত একাকার করে মাটি দিয়ে তৈরি করছে বিভিন্ন মৃৎ পণ্য। কিন্তু সঠিক দাম না পাওয়ায় আর বর্তমান অবস্থায় কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে এ সকল কারিগররা। বর্তমানে গ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন উৎসব, মেলায় তৈরি খেলনা পুতুল ছাড়া অন্য কোন মৃৎ শিল্পের গ্রাহক নেই বললেই চলে। বর্তমানে অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক ও স্টিলের জিনিসপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির মুখে পড়েছে। ফলে এ পেশায় জড়িত বিশেষ করে এটাই যাদের একমাত্র অবলম্বন- তাদের জীবনযাপন একেবারেই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মৃৎ শিল্পীরা মাটি দিয়ে তৈরি করছেন পুতুল, ফুলের টব, কুয়ার পাত, হাঁড়ি, পাতিলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। পরে সেগুলোকে তারা শহরের দোকান এবং বাসা বাড়িতে বিক্রয় করে থাকেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে মৃৎ শিল্পের ব্যবহার তেমনটা এখন আর চোখেই পড়েনা। এখন সৌখিন জিনিসপত্র এবং কূয়ার পাতই একমাত্র ভরসা।
ফলদা মৃৎশিল্পের পুরনো কারিগর মঙ্গল পাল (৬০) জানান, এখন মাটির তৈরি কোন কিছু মানুষ কিনতে আসেনা। এখন প্লাস্টিক আর কাঁচের তৈরি বিভিন্ন ধরণের খেলনা ও শো পিচ কিনতে সবাই ব্যস্ত। মহন পাল নামে আরেক কারিগর বলেন, আমাদের তৈরি মৃৎ শিল্পের বাজারদর ভালো ছিল। কিন্তু প্লাস্টিক আর কাঁচের ব্যবহার বাড়ার কারণে আজ আমাদের ব্যবসা ধ্বংসের পথে। এতে অনেকেই পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
এবিষয়ে ভূঞাপুর শহরের মৃৎশিল্প ব্যবসায়ী রাজন পাল বলেন, আগে ব্যবসা ভালো চলতো। আগে যখন শিসা, প্লাস্টিকের মাল ছিলনা, তখন আমরা রমরমা ব্যবসা করতাম। আার এখন মাটির তৈরি জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ নেই। এখন মাটির জিনিস চলে কম। অন্যান্য কাজ করে আমরা এগিয়ে যাই, কিন্তু আমরা মাটির কাজ করে এগিয়ে যেতে পারছিনা। আমার বয়স যখন ১০-১২ বছর, তখন আমি ২টাকা থেকে ৫টাকা করে পাতিল বিক্রি করতাম। আগে অনেক লোকজনই এই ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ছিল। বর্তমানে অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছে। আগে যে পরিমাণে বিক্রি হতো, তার থেকে এখন ৪ ভাগের ১ভাগ বিক্রি হয়। আবার অনেক সময় চলেই না। এখন আমাদের ব্যবসায় একেবারেই অচল। যারা এ ব্যবসায় স্মৃতি হিসেবে ধরে রেখেছে, তারা একদমই চলতে পারেনা।
মৃৎশিল্প ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ি গবেশ পাল বলেন, আমাদের এই ব্যবসায় এখন ১৬আনার মধ্যে ৬ আনা চলে, ১০ আনাই চলেনা। আমাদের ছেলে-মেয়ে আছে, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতে গেলে যে অর্থের দরকার, এই ব্যবসায় থেকে তা উঠানো যায়না। চাকরিরক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা লাগতেছে এই টাকা দিবে কে। আর এ জন্যই আমরা ভাত পাই বা না পাই বাধ্য হয়েই এই কাজ করতেছি।
মৃৎশিল্প ব্যবসায়ী নিতাই পাল বলেন, আমাদের এই ব্যবসায় এখন চলেনা, এই ব্যবসায় এখন কোন ভেলু নাই। বৃদ্ধ বয়সে এখন কি করব, তাই জোর করেই এই ব্যবসায় করি। সিলভার, প্লাস্টিক, স্টিলের পন্য নামার কারণে এই ব্যবসায় অচল হয়ে যাচ্ছে। কলসি, হাড়ি, পাতিল এগুলো এখন একদমই চলেনা। এই কাজ করে আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানো খুব কষ্ট হয়ে পড়ে। তিনি আরো জানান, আধুনিক তৈজসপত্রের প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে বিলুপ্তির পথেই এগিয়ে চলছে মৃৎশিল্প।