বাংলাদেশরাজনীতিসর্বশেষ নিউজ
এই ঈদে টাঙ্গাইলের জামদানি শাড়ীই রমনির আকর্ষণ শীর্ষে
মুক্তার হাসান, টাঙ্গাইল থেকে: এবারে ঈদে সারাদেশে রমনিদের নজর ও আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছে টাঙ্গাইলের জামদানি শাড়ী। আধুনিকতার স্পর্শ আর রং ও রূপের বৈচিত্রেই এ শাড়ী রমনির নজর কেড়ে চাহিদার শীর্ষে অবস্থান পেয়েছে বলে মনে করছেন এর উদ্যোক্তরা। এ ঈদকে ঘিড়ে দেশের প্রায় প্রতিটি সপিং মল, মার্কেট ও বিপনী বিতানে লেগেছে এ শাড়ী কেনাবেচার ধুম। এর ফলে মহাজনদের সরবরাহের চাহিদা পূরণে তাঁতের জামদানি শাড়ী তৈরিতে তাঁত শিল্পীদের চলছে বিরামহীন প্রতিযোগিতা। এ নিয়ে সরগরম হয়ে উঠেছে এ শিল্প অঞ্চল।
জানা যায়, প্রাচীন কাল থেকে টাঙ্গাইলের দক্ষ কারিগররা তাদের বংশ পর¤পরায় তৈরি করছেন বিশেষ এ শাড়ী। এর উৎপত্তি বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাং- এর ভ্রমণ কাহিনীতে টাঙ্গাইলের বস্ত্র শিল্প অর্থাৎ তাঁত শিল্পের উলেখ রয়েছে। বর্তমানে এ তাঁতের শাড়ির জন্যই টাঙ্গাইলের সুনাম ও পরিচিতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী সমাদ্রীত। প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যে আর লোক-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যে টাঙ্গাইল জেলার অবস্থান অনেক উঁচুতে। আর এ উঁচুতে নেয়ার কান্ডারি হিসেবে সবচেয়ে দাবিদার টাঙ্গাইলের এ তাঁত শিল্প।
টাঙ্গাইলের তাঁত পলীর উৎপত্তি স্থলে সদর উপজেলার ধুলটিয়া, বাজিতপুর, সুরুজ, বার্থা, বামনকুশিয়া, ঘারিন্দা, গোসাইজোয়াইর, তারুটিয়া, এনায়েতপুর, বেলতা, গড়াসিন, সন্তোষ, কাগমারী, বেলতা। কালিহাতী উপজেলার বলা, রামপুর, ছাতিহাটি, আইসরা, রতনগঞ্জ কোবডোরা। দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, চন্ডি, নলুয়া, দেওজান, নলশোঁধা, বিষ্ণুপুরে তৈরি হচ্ছে এ শাড়ী। এছাড়া গোপালপুর ও ভ‚ঞাপুর উপজেলার কিছু কিছু গ্রামে এ তাঁত শিল্প রয়েছে।
টাঙ্গাইলের তাঁতের জামদানি শাড়ী তৈরি করতে হাতের কাজ করা হয় খুব দরদ দিয়ে, গভীর মনোযোগের সাথে অত্যন্ত সুক্ষè ও সুদৃশ্য ভাবে। পুরুষেরা তাঁত বোনে; আর চরকাকাটা, তানা পারির কাজে সহযোগিতা করে তাদের পরিবারের মহিলারা। তাঁতিরা মনের রঙ মিশিয়ে শাড়ীর জমিনে শিল্প সম্মতভাবে তাঁত মেশিনের মাধ্যমে নানা ডিজাইন ও নকশা তৈরি করে। এ নকশা, বুনন, ও রঙয়ের ক্ষেত্রে রয়েছে অতুলনীয় বৈচিত্র।
আরমান, আশরাফ, বছু, জহির নামের কয়েক জন শ্রমিক জানান, অনেক কষ্ট সহ্য করতে পারলে একদিনে একটি জামদানি শাড়ী তৈরি করা যায়। অন্যথায় দুই দিন সময় লাগে। আবার প্রকার ভেদে কোন জামদানি শাড়ী তৈরি করতে তিন থেকে চারদিনও সময় লেগে যায়। ডিজাইন অনুপাতে আমরা কোন শাড়ীতে ৫শ’ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত শ্রমিক মজুরি পেয়ে থাকি।
মমিনুর রহামান নামের এক তাঁত মালিকের সাথে সরেজমিন আলাপকালে জানা যায়, রঙ বেরংয়ের রেয়ন, জরি, ও উন্নত মানের মোলায়েম চিকন সুতার মাধ্যমে আমরা এ টাঙ্গাইলের জামদানি শাড়ী তৈরি করে থাকি। এবার ঈদে রমনিদের নজর কেড়েছে আমাদের তৈরি টাঙ্গাইলের জামদানি শাড়ী। এ সকল গ্রামে দিন রাত শোনা যাচ্ছে মাকুর মনোমুগ্ধকর খটখটি শব্দ। বিশেষত সদর উপজেলার বাজিতপুর ও করটিয়ার হাট থেকে এ জামদানি শাড়ী পাইকারি ক্রেতাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পরছে সারাদেশে।
জেলা শহরের সমবায়, খান প্লাজা, হিরা সুপার মার্কেট সহ বেশ কয়েকটি মার্কেট ঘুরে কয়েকজন মহিলা ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায় দাম একটু বেশি হলেও অত্যাধুনিক বাহারি ডিজাইনের তাদের পছন্দের জামদানি শাড়ী ক্রয় করতে পেরে তারা বেজায় খুশি।
বিক্রেতারা জানিয়েছেন, ডিজাইন, রঙ, হাতের কাজ, ও সুতার গুনাগুন ভেদে ৭শ’, ১৪’, ১৮শ’, ২৩শ’ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে জামদানি শাড়ী। পাঁচ প্রকার জামদানি রয়েছে আমাদের দোকানে যেমন, ঢেউ, আম, রহিতন, তারা, ডাবল আম, ডেমরা। এ শাড়ী দৈর্ঘ্য ১২ হাত, ব্লাউজ ২ হাত ও প্রস্থ ৪৬ ইঞ্চি।
আমির আলী নামের আরেক ব্যবসায়ী জানান, টাঙ্গাইলের শাড়ির বৈশিষ্ট্যে রয়েছে কাপড়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুক্ষ কারুকাজ।
এ শাড়ি তৈরি করার জন্য আমরা ৮০, ৮২, ৮৪ ও ১শ’ কাউন্টের সূতা ব্যবহার করে থাকি। তবে এর মধ্যে ৮২ কাউন্টের সুতা বেশি ব্যবহার করা হয়। আর এবার ঈদে আমরা জামদানি শাড়ী বিক্রি করে বেশ লাভবান হচ্ছি।
পৃথিবীর ইউরোপ, আমেরিকার , জাপান, সৌদিআরবসহ ভারতে টাঙ্গাইলের এ তাঁতের শাড়ির রয়েছে ব্যাপক কদর। অন্যান্য দেশের শাড়ি ১০ হাত থেকে সর্বোচ্চ ১১ হাত মাপে তৈরি হয়ে থাকে, আর টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরি হয় ১৪ হাত মাপে। এ শাড়ি নরম মোলায়েম এবং পরতে আরাম, টেকসই। এ ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সময় ও চাহিদার সাথে তাল মিলিয়েই দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে টাঙ্গাইল শাড়ির আকর্ষণ ও নকশার সাদৃশ্যতা।
তবে এ ব্যাপারে পাথরাইলের বিশিষ্ট শাড়ী ব্যবসায়ী ও যজ্ঞেষর এন্ড কোং এর স্বত্তাধিকারী রঘুনাথ বসাক জানান, ২০০১ সালে এ অঞ্চলে ৭৫ হাজার ৪’শ ৬০টি তাঁত ছিল। এর মধ্যে পিটলুম ছিল ২৭ হাজার ৬’শ ৮২, চিত্তরঞ্জন ৪৭ হাজার ৩’শ ৫৩ ও পাওয়ার লুম ছিল ৪’শ ২৫টি। এর সংখ্যা ২০১৪ সালে পিটলুম ৮ হাজার, চিত্তরঞ্জন ৫১ হাজার ও পাওয়ার লুম দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১’শ। গত ১০ বছরে প্রায় ৬০% তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রমিক মজুরী ও মালামালের দাম বৃদ্ধির পরও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কাপড়ে বাজার সয়লাভ ও বাজার দখলমুক্ত রাখতে ক্রেতার চাহিদা ও মূল্যের প্রতি সুদৃষ্টি রাখা হয়েছে। তার উৎপাদিত ও চাহিদাপূর্ণ বিশেষ জামদানি শাড়ীর মধ্যে রয়েছে ফুল সিল্ক যার পাইকারী মূল্যই প্রায় ৩০ হাজার টাকা। এছাড়াও ১৬’শ থেকে ২৫’শ টাকার মার্সচাইট কটন শাড়ীর রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। তার উৎপাদন ১৬ লাখ পিছ ও বিক্রি প্রায় ৯০ শতাংশ।
ভারতীয় শাড়ী আমদানি বন্ধসহ এতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের এ তাঁত শিল্পকে বাঁচাতে সরকার প্রয়োনীয় পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।