বাংলাদেশসর্বশেষ নিউজ
ঝিনাইদহের ঐতিহ্য বেত সম্প্রদায়
জাহিদুর রহমান তারিক, ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ বাবুজি আমরা এখন খুবই দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। আগে আমাদের এ বাঁশের তৈরী হস্তশিল্পের কাজের রোজগারে মুটামুটি খেয়ে পরে ভালই কাটতো। এখন একাজে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বাপ দাদাদের ব্যবসা তাই কষ্ট হলেও ধরে আছি।
এ শিল্প তৈরী হয় শুধু মাত্র বাঁশ দিয়ে । এখন এ শিল্পের জন্য এলাকায় বাঁশের বড়ই অভাব দামও বেশী। যে কারণে সাধ্য অনুযায়ী দামে বাঁশ যোগাড় করতে ভিটে মাটি ছেড়ে বহু দূরে বছরের পর বছর কাটাতে হয় সুবিধাজনক কোন সরকারী পরিত্যাক্ত ঘরে।
ওখানেই দিনে-রাতে আমরা হস্তশিল্পের কাজ করে থাকি। এতে খরচ কিছুটা হলেও সাশ্রয় হয়। কথা গুলি বলছিলেন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার জয়দিয়া উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পরিত্যাক্ত বিল্ডিং-এ অবস্থান নেয়া বেত সম্প্রদায়ের একটি পরিবারের কর্তা শ্রীমন্ত বেত (৭০)।
চলতি পথে এ বেত সম্প্রদায়ের হস্তশিল্পের নিপুঁন হাতের কাজ দেখে এ প্রতিবেদক অনেকটা কৌতুহলি হয়ে তাদের সাথে কাটান ঘণ্টা দুয়েক। সেখানে যাওয়াবাঁশ (ফাঁপা বাঁশ) দিয়ে তৈরী হচ্ছে লাল সবুজ রংয়ের মিশ্রিত কুলা, ঝুড়ি, পেঁতেঝুড়ি, শরপোস, ডালাসহ বিভিন্ন গ্রেহস্থলীর জিনিস পত্র।
তাদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েসহ বয়বৃদ্ধরাও কাজ করে যাচ্ছেন সমান তালে। কেউ মাপ অনুযায়ী কাটছেন বাঁশ, কেউ বাঁশ থেকে তুলছেন সুক্ষ কাগজের মত পাতলা চটা, আবার ওই চটা শুকিয়ে লাল সবুজ রং লাগাতে ব্যাস্ত কেউ কেউ। বাকীরা ওই রং বে-রংয়ের চটা দিয়ে কুলা, ঝুড়ি, পেঁতেঝুড়ি, শরপোস, ডালা বুনছেন নিপুঁন হাতে।
ওই পরিবারের কর্তা শ্রীমন্ত বেত-এর বাড়ী চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা’র গোবিন্দপুর গ্রামে। ওই গ্রামের বেশির ভাগ বেত সম্প্রদায়ের লোকজন একত্রে বসবাস করেন। কয়েক দিন আগে স্ত্রী সন্তানসহ কয়েকজন নিকটাত্মীয়কে নিয়ে উঠেছেন কোটচাঁদপুর উপজেলার জয়দিয়া উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে’র পরিত্যাক্ত বিল্ডিং-এ।
শ্রীমন্তের বড় ছেলে মনো বেত (৩৫) জানান, নিজের এলাকায় বাঁশের অভাবতো আছেই তার উপর আবার দামও বেশী। তাছাড়া এসব সমগ্রী এখন প্লাষ্টিকের তৈরী হচ্ছে যা বাজার ছেয়ে গেছে। যে কারণে বাঁশের তৈরী এ হস্তশিল্পের বিক্রিও কমে গেছে। সেই সাথে বেশী দামে বাঁশ ক্রয় করে এ শিল্পে লাভ হয় না। যেকারণে বাধ্য হয়েই যে এলাকায় এ শিল্পের জন্য তৈরী উপযোগী সহনীয় দামে বাঁশ পাওয়া যায় সেই এলাকাতে আমাদের চলে আসতে হয়।
এখানে এ শিল্পের উপকরণ ঠিকমত পেলে আমরা ২ থেকে ৩ বছর থাকতে পারি। তারপর আবার এলাকাতে ফিরে যাব। এখন শুধু যোগযাত্রার সময় এলাকাতে যাওয়া পড়বে। মনো বেত বলেন, একদিকে অভাবের তাড়না অন্যদিকে এ শিল্পের উপকরণ পেতে আমাদের এলাকা ছাড়তে হয়। যে কারণে সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর ইচ্ছা থাকলেও তা পারিনা। তাই বাধ্য হয়েই সন্তানদের পূর্ব পুরুষের পেশায় মনোযোগী করে তুলতে হয়।
মনো বেতে’র মামা বাসুদেব বেত (৪৫) বলেন, আমরা এখানে একত্রে হস্তশিল্পের সমগ্রী তৈরী করে বিভিন্ন বাজারের দোকান গুলোতে পাইকারী দামে বিক্রি করে থাকি। পাশাপাশি নিকটে কোন মেলার বাজার বসলে আমরা নিজেরাও সেখানে কিছু বাড়তি পয়সার আসায় খুচরা দামে এ মালামাল বিক্রি করে থাকি। বর্তমানে প্লাষ্টিকের সমগ্রী বাজার ছেয়ে যাওয়ার আগের মত এ হস্তশিল্প বিক্রি হয় না।
তারপর আবার এ হস্তশিল্পে ব্যবহৃত যাওয়াবাঁশ ক্রমেই বিলুপ্ত হচ্ছে সেইসাথে দামও দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের এ হস্তশিল্পের কাজ ধরে রাখা কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়েছে। যে কারণে এ হস্তশিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের অতিসত্ত¡র এ হস্তশিল্পের প্রতি নজর দেয়া উচিত।
তা না হলে অচিরেই বেত সম্প্রদায়সহ কয়েক লাখ হস্তশিল্প কর্মি বেকার হয়ে পড়বে বলে আশংকা প্রকাশ করেন বাসুদেব বেত।