বাংলাদেশ

সৃষ্টির সেরা জীবের বর্বর ও হিংস্র হওয়ার পিছন্র মানব সন্তানের ভুমিকা II নাসরিন ইসলাম

নাসরিন ইসলামঃ হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে মনটা। যখন কোন মানব সন্তানের কষ্ট দেখি বা কোন নীতিহীন কর্মকান্ডে সর্বোচ্চ সাজা হোক মনেপ্রাণে চাইও বটে। কিন্তু যখন সাজা পাচ্ছে শ্রবন করি। নিজকে আর সামলাতে পারিনা। বুক পাঁজরে চিনচিন ব্যথা অনুভব করি। অতঃপর দ্রুতলয়ে নুহ্য, ভঙ্গুর হতবিহ্বল বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।

নীচে দুটো বিষয় তুলে ধরলাম। কৃতিত্ব নেবার জন্য নয়। শুধু মাত্র ন্যায়ের পক্ষে নৈতিকতার প্রশ্নে বিবেকের দংশন হতে নিস্তার লাভের জন্য একটু সোচ্চার হয়ে কৌশলে প্রতিবাদ করলে সহস্র অমানবিক কর্মকান্ড হতে আমরা পরিবার ও সমাজ কে রক্ষা করতে পারি——–কারন অসৎ ও নীতিহীন মানুষ সদাই মানষিকভাবে দুর্বল থাকে।

দেখেছি মসজিদ হতে মুসুল্লীদের একজোড়া স্যান্ডেল চুরি করে ধরা পড়েছে এক মানব সন্তান । যার স্যান্ডেল নিলো সে মাফ করে দিয়ে স্যান্ডেল পেয়ে চলে গেলো। কিন্তু সাধারণ জনগন চোর চোর চিৎকার করে মানুষ একত্রিত করে বেদম প্রহারে কাবু করে অতঃপর এক পর্যায়ে দেয়ালে তার মাথাটি সজোরে ঠুকছে। সামান্য একজোড়া স্যান্ডেল চুরি করার দায়ে তাকে এমন বর্বরোচিত অত্যাচার সহ্য করতে হবে! হয়তো নিজের বা সন্তানের পেটে দুমুঠো খাবার তুলতে সে এই কাজটি করেছে। এই সমাজ কি তার সে খবর রাখেন?

মানুষ যখন দীর্ঘদিন অর্ধাহারে অনাহারে থাকে। তখন ঐ বুভুক্ষু মানুষ টি পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট কর্মটি করে পেটের খাবার দিতে পিছপা হননা। বাস্তব জীবনে বহুবার দেখেছি এই নির্মম সত্যটি আর উপলব্দি করেছি ততোধিক বার। যাই হোক বিবেকের দোরে কড়া নাড়লো যেন কেউ। জোরালো কন্ঠে জনগন নামক এমন পিশাচদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলাম। অন্য একজন লার্নেড ও আমি একত্রে প্রতিবাদ করলাম। কারণ আমার সামনে একজন মানুষ এমন মানুষ খেকোদের হাতে প্রাণ হারাবে! এটা মেনে নিতে পারিনি। চোখের সামনে এমন করুণ ভয়ংকর দৃশ্য। প্রতিবাদের কড়া ভাষায় ভড়কে চলে গেছে জনগন নামক হন্তারকগন। যাকে চুরির দায়ে বেধম প্রহার করছিলো ঐ অসহায় লোকটি দৌড়ে নিমেষেই উধাও বনে গেলো। আমি তার পথচেয়ে তাকিয়ে রইলাম!

এলএলবি ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই সানন্দে ঢাকা জজ কোর্টে আগাম কিছু শিখার জন্য হাইকোর্টে এর সন্মানিত ডেপুটি এটর্নী জেনারেল এ্যাডভোকেট একেএম দাউদুর রহমান মিনা স্যার এর সাথে কাজ শুরু করি রেজাল্ট হওয়ার আগেই। জজকোর্ট হতে কাজ শেষে আমি আর একজন শিক্ষানবীশ আইনজীবি যারা একত্রে স্যার এর সাথে রয়েছি।

বাসে করে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। কোন একটা স্টপেজ এ বাসটি থামার সাথে সাথে লোকজন উঠে। তন্মধ্যে মধ্য বয়সী এক ভদ্রলোক আমাদের সীটের পাশে দাড়ায়, সীট পায়নি তাই। বরাবর ই আমি জানালার পাশে বসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি বিধায় লার্নেড আমায় জানালার পাশে সর্বদা বসতে দেন।

যাই হোক আসল কথায় আসি, লোকটির হাতে একটি কাপড়-চোপড়ের ব্যাগ নিজের পায়ের কাছে রাখেন। হঠাৎ একজন গালিবার সাইজের মানুষ কিছু লিলিপুট টাইপের মানব সন্তানদের নিয়ে বাসে উঠে লোকটিকে বকাঝকা করছে আর লিলিপুটরা তাকে লাফিয়ে লাফিয়ে চড় মারার চেষ্টায় রত। গালিবার টাইপের লোকটি একটি বাক্য বারংবার উচ্চারণ করছেন, কি দোকানের লোকজন তুই মারছিস ক্যান?

নীরিহ যাত্রী বেচারার একই উত্তর আমি কাউকে মারিনি এমন কি বকাও দেইনি বিশ্বাস করেন। পুরো হৈ হুল্লোড় গাড়ীতে কিন্তু কেউ কিছু বলছেনা। সবাই মুখে সীল গালা করেছে। আমি কলিগের কাছে বিষয়টি বুঝতে চাইলাম তিনি বললেন, মনে হয় ডিবি পুলিশ । কিন্তু গালিবার এর পোষাক দেখে আমার ডিবি পুলিশ মোটেই মনে হয়নি। হাতে মোটা শিকল টাইপের একটি ব্রেসলেট পরা, গলায় মোটা শিকল ধরনের চেইন ঝুলছে। জিন্স ও টি সার্ট পরা থাকলেও এমন আজব সাজ-সজ্জা দেখে আমার মনে হলো। রোডের পাশে পলিথিন ছালা বস্তা ঘরে তার বসবাস। তবে নিজকে শহুরে বানানোর প্রচেষ্টায় রত আছেন। আমি গালিবার এর ঐ লোকটির প্রতি আচরণ দেখে কিছু বলতে চাইলে বারংবার লার্নেড আমায় থামিয়ে দেয়। ঝামেলায় জড়াবেন না প্লিজ নাসরিন আপা।

বড় রকমের সমস্যায় পড়বেন। পরবর্তীতে আমাদের যাতায়াতের সমস্যা হবে। তারপরও আমি বিষয়টি লার্নেড কে বুঝতে না দিয়ে পর্যবেক্ষন করে চলছি। কিছুক্ষণ পর গালিবার গালিগালাজ করতে করতে যাত্রীর পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটি হাতড়ে একটি খবরের পেপার প্যাঁচানো কি যেন বের করে বললো এটা কি?

তখন আমি ভাবলাম বোমা হয়তো! কিছুটা ভড়কে গেলাম। মুহূর্তে ভাবনা জাগলো বাসায় ছেলে-মেয়েদের কাছে বুঝি ফেরা হলোনা! দেখা হবেনা বুঝি কভু আর প্রাণের স্বজনদের সাথে! প্রভূ এ কোন মৃত্যু উপত্যকায় দাড়িয়ে আমরা প্রহর গুনছি! এইবার বুঝি সব শেষ হয়ে গেলো! কিন্তু না, এর মধ্যে-ই গালিবার ঐ যাত্রীটির মাথায় যখন ঐ পেপারে প্যাঁচানো জিনিসটি দিয়ে আঘাত করার জন্য উদ্যত হলেন।

অমনি পেপার একটু সরে গেলে দেখতে পেলাম একটি bottle green কালারের কাঁচের বোতল। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই বোতল দিয়ে যেভাবে সজোরে আঘাত করতে চলছেন গালিবার লোকটির মাথায়। তাতে নির্ঘাত মৃত্যু। মুহূর্তেই মন কুঁকড়ে উঠলো, আমার সামনে এমন নৃশংসভাবে মানুষটি খুন হবে? তথাপি কোন কিছু আর না ভেবেঁ সাথে সাথে গালিবার এর হাতটি দাড়িয়ে ধরে ফেললাম আঘাত হানার পূর্বেই । আর জোরে চিৎকার করে বললাম আপনি তো মানুষটিকে খুন করতে যাচ্ছেন? এভাবে আঘাত পেলে মানুষটি মরে যাবে? ভেবেছেন কি একবারও? এর মধ্যে বাসের সবার টনক নড়লো তারাও প্রতিবাদ করে গালিবার কে তার দলবল সহ নেমে যেতে বাধ্য করলো।

গালিবার বোতলটি নিয়ে নেমে গেলো। পরে বাস যাত্রীদের কথোপকথনে বুঝতে পারলাম ওটা ছিলো দামী কোন মদ সহ বোতল। আমি নিজকে নিজের ধিক্কারের হাত হতে রক্ষা করলাম। তখন শুধু একটি কথাই মস্তিস্কে ঘুরপাক খাচ্ছিলো জলজ্যান্ত লোকটি এভাবে আমার সামনে খুন হয়ে যাবে! নিজকে সামলাতে পারিনি কারণ আমি জানতাম এমন নৃশংস ঘটনা আমার সামনে ঘটলে, সারাজনম এই অপরাধের দায়ভার নিজের বিবেক কে দংশন করতো আর তিলেতিলে কুড়ে কুড়ে খেতো নিজ সত্তা ।

আহ্ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের একি করুণ হাল! ভয়ংকর চিত্র। কভু এদের বর্বর, হিংস্র, পৈশাচিক কর্মের জন্য বিষিয়ে উঠে মন-প্রাণ। তথাপি দেহ হতে আত্মা সপ্তআসমানে ছুঁটে চলে আবার বিষাদ বিষন্নতার পাথারে অবগাহন করে চলে দিবা-নিশি সহস্রাব্দ প্রহর। বেদনা ভর করে মনোভুমে, অস্থি-মস্তিস্কে ধীরলয়ে। অনুশোচনায় বিমর্ষতা, ক্লেশে লাল-নীল অতঃপর ধূসর কালোতে সয়লাব জনম।

মানুষ জন্ম নেয় নিস্পাপ নির্মলতায় ভরপুর তনুমন নিয়ে। আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে আর প্রথমত মৌলিক চাহিদার প্রথম তিনটি শর্ত বাস্তবায়নে উদগ্রীব হয়ে পরিবার সমাজ ব্যবস্থায় জটিল সমীকরণে নিজকে বিপথগামী করে ফেলে। হায়রে পরিবার! হায়রে সমাজ! যারা আমাদের দু’বেলা দুমুঠো ভাত খাইয়ে আদর্শে বড় করতে পারেন না। এমন মা-বাবার সন্তানের দরকার কি?

আর সমাজ ব্যবস্থা? এটা মানুষের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যানের জন্য সৃষ্টি। মানুষ দলবদ্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে। সেই সমাজ যদি আমাদের কল্যান বয়ে আনা তো দূরের কথা কিছু মানুষের স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্য মানব সন্তান কে ব্যবহার করার ফলে ব্যবহৃত সৃষ্টির সেরা জীব পিশাচ কীট বর্বর হিংস্রতে পরিনত হয়। তখন নিজকে খুব অপরাধী মনে হয়। বেঁচে থাকার ইচ্ছেটার বিলুপ্তি ঘটে।

তাই ভারাক্রান্ত এই মনে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, অমানবিক মুল্যবোধহীন সেই সমাজ ব্যবস্থাকে আনবিক বোমায় গুড়িয়ে দিতে । এই ভঙ্গুর পৈশাচিক রাহুরদশা হতে মুক্ত করণের লক্ষ্যে, কলম নামক আনবিক বোমাটি ধ্বংস করে দিক এমন হীন চরিতার্থ সমাজ ব্যবস্থার সমস্ত কলংকের অধ্যায়। প্রতিবাদ মুখর লেখায় গর্জে উঠুক কলম, সোচ্চার হোক কলম যোদ্ধারা পার্থিব জগত নির্মল করণের প্রশ্নে……..’ হে প্রভূ আমাদের রক্ষা করুন’

১৮ নভেম্বর ২০১৯ ইং

Related Articles

Close